ঘুম ভাঙার আগেই পিঠের ওপর পানির ঝটকায় চোখ খুলে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে কুকুরটি। তীব্র শীতে চা–দোকানের চুলার উত্তাপে ঘুমিয়ে ছিল। সকালে মাঝবয়সী দোকানি এসেই তাড়িয়ে দিল। কুকুরটির সঙ্গে তার প্রতিদিন দেখা হয়। কাঁচাপাকা দাড়ি, আকাশি রঙের পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া বেশি পরেন। মুখে সব সময় পান থাকে। দাঁতগুলো পানের তোড়ে কালো হয়ে আছে। প্রতিদিন দোকানি আসার অপেক্ষা করে কুকুরটি। দোকান খোলার পর মাঝেমধ্যে বাসি পাউরুটি, বিস্কুট দেয়। খদ্দেররাও মাঝেমধ্যে খেতে দেয়। বাচ্চা হওয়ার পর থেকে দোকানি তাড়িয়ে দেয়। আজও তাড়িয়ে দিল। স্টেশনের পাশে খাবার হোটেলের উত্তপ্ত চুলার কাছে গেলেও একইভাবে তাড়িয়ে দেয়।
যে কয়টা বাচ্চা হয়েছিল, তার মধ্যে একটাই বেঁচে আছে। তীব্র শীতে বাচ্চাটি থরথর করে কাঁপছিল। মা কুকুরটি শীত থেকে সুরক্ষিত রাখতে সন্তানকে নিয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা চিৎকার শুনতে পায়। পেছন ফিরে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বাচ্চাটিকে। গাড়িওয়ালা একবারের জন্যও বাস থামানোর প্রয়োজন মনে করেনি। কুকুরের জীবন গেলে কার কী আসে-যায়!
তারপর কয়েক বছর কেটে যায়। আবারও শীত এসেছে। পাতারা ঝরে যায়, লোকেরা ঘরে যায়। ঘুমিয়ে পড়ে গরম বিছানায়। শীতের সংগ্রাম ব্যর্থ হয় কম্বলে থাকা মানুষগুলোর কাছে। ব্যর্থ শীত যেন আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির মতো ঢুকে পড়ে রাস্তায়, ভাগাড়ে; কুকুর, বিড়াল ও ফুটপাতে থাকা মানুষের জীবনে! বিষণ্ন মন নিয়ে মানুষের মুখের দিকে তাকাতেই কুকুরটি দেখতে পায় মানুষগুলো আস্তে আস্তে সাদা রোদ হয়ে হাসছে। একটি নয়, অসংখ্য। ক্ষুদ্র এবং গোলাকৃতির। কয়েকটি রোদ অদ্ভুত দেখতে। কিছু রোদের লেজ, কান এবং চারটি নখাবৃত পা-ও আছে। একটি রোদের গোলাপি রঙের পাখা আছে, সে ইচ্ছেমতো উড়ছে! রোদটি দেখতে তার মৃত সন্তানের মতোই! উড়তে উড়তে গোলাপি পাখাওয়ালা রোদটি চেনা গন্ধ নিয়ে নেমে আসে তারই কাছে! কুকুরটি পিটপিট করে চোখ খুলতে চেয়ে আবার বন্ধ করে ফেলে।
কিছুদিন আগে আবারও বাচ্চা দিয়েছে মা কুকুরটি। শুনেছে মানবিক মানুষেরা কম্বল দেবে শীতার্তদের। এই খবর পৌঁছে যায় পথে থাকা তারই মতো বিড়াল ও কুকুরদের কাছে। মানুষের মতো তারাও যে শীতার্ত।
কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে যায়। অনেক মানুষ। অনেক ভিড়। স্তূপ স্তূপ কম্বল দেখে খুশি হয় কুকুরটি। সেও কম্বল পাবে। বাচ্চারা শীতে উষ্ণতা পাবে। খুশিতে মানুষের মতোই অপেক্ষা করছিল! স্তূপের সব থেকে নিচে একটি গোলাপি রঙের কম্বল পছন্দ হয় কুকুরটির। যত মানুষ এসেছিল, সবাই কম্বল পেয়ে চলে যায়। কুকুরটিকে কেউ কম্বল দেয় না।
বিতরণ শেষে পড়ে থাকে গোলাপি কম্বলটি। কুকুরটি এগিয়ে যায়। ঘেউ ঘেউ করে কম্বলটি চায়। বারবার তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তবু সে ফিরে যায় কম্বল রাখা টেবিলের কাছে। একপর্যায়ে বিতরণকারী একজন কম্বলটি হাতে নিয়ে সরে যাওয়ার সময় কুকুরটি কম্বলে কামড় দিয়ে বসে। ছাড়াবার চেষ্টা করেও কেউ যখন ছাড়াতে না পারে, তখন মাথা বরাবর আঘাত করে কুকুরটির। লোকেরা ভাবে মানুষকে আক্রমণ করেছে।
আঘাত পেয়ে কুকুরটি কাত হয়ে পড়ে যায় মাটিতে। চোখ ঝাপসা হলেও দেখতে পায় তার ছিটকে যাওয়া রক্ত কম্বলে মেখে যাওয়ায় সেটি ফেলে দেওয়া হয়েছে তারই পাশে। অথচ সে কামড় দিতে নয়, কম্বলটিই চেয়েছিল।
মানুষের পায়ের শব্দ কমতে থাকে। নিঃসঙ্গতায় পড়ে থাকে কুকুর ও গোলাপি কম্বল। আস্তে আস্তে হুঁশ ফিরে আসে কুকুরটির। আঘাত নিয়েই আবার দাঁড়ায়। কম্বলটিকে মুখে কামড় দিয়ে হাঁটতে থাকে বাচ্চাদের দিকে।
সিরাজগঞ্জ সদর