কবরীর ‘আয়না’ বর্তমান সমাজের দর্পণ

কবরী, ২০১৬সুমন ইউসুফ

দীর্ঘ ৫৭ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে দেড় শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কবরী। বাংলাদেশের সাদাকালো চলচ্চিত্রজগতের স্বর্ণালি দিনের চিরসবুজ মিষ্টিমুখ। এই মুখ দয়িতের বুকে দয়িতার, গ্রামবাংলার জনম দুঃখিনী দুহিতার, মায়া–মমতায় লড়াইয়ের পথ ধরে উঠে আসা, গড়ে ওঠা সংগ্রামী এক মা এবং আমাদের সহজ সরল বহমান জীবনের পাশের বাড়ির তিরতিরে নদী, মেয়েটি। এই মুখের হাসি সবুজ পাতার ওপর সুন্দর ফুলের মতো আমাদের বুকের ভেতরে স্নিগ্ধ লাবণ্যে ভরপুর অমলিন বসে থাকে। তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, তোমার মুখের পানে চেয়ে চেয়ে আমরাও সুন্দর হয়ে যাই। সুন্দর হয়ে ওঠি।

এই ফুলের জলসায় কখনো কখনো আমাদের নীরবও হয়ে যেতে হয়। রূপসাগরে অরূপ রতন তুলে আনতে গিয়ে আমরা দেখি, পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্যকে ধ্বংস করতে উন্মত্ত হয়ে থাকে এক দল হায়েনা। তাদের করাল থাবায় লোভী চিকচিকে লালসার ঝরে পড়া লালে, পদাঘাতে সব সুন্দর দলিত–মথিত লাঞ্ছিত–লুণ্ঠিত হয়ে যায়। চিরতরে গ্রাস করে ফেলতে চায়। কিন্তু এই অবাঞ্ছিত ঘটনা কখনোই সমাজের মূলধারা নয়। শুরু হয় অসুন্দরের সঙ্গে সুন্দরের সংগ্রাম। ২০০৫ সালে কবরী সারোয়ার নিজেই নির্মাণ করলেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’। এই আয়নায় প্রতিফলিত হলো সমাজের বৃহত্তর এক প্রেক্ষাপট, কুৎসিত কিছু ঘটনা, নারীর ওপর যা চিরকাল ঘটে চলে। সুন্দরের সঙ্গে অসুন্দরের লড়াইয়ে, সুন্দরকে জিতে নেওয়ার সামাজিক এক বার্তা।

আবার সামাজিক বার্তা দিতে গিয়ে রচিত কিছু রচনায়, নাটকে বা নির্মিত চলচ্চিত্রে অনেক সময় আমরা দেখি সৃষ্টিশীল চেতনা, শৈল্পিক নৈপূর্ণ গুণাবলি তেমন থাকে না। বার্তাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাকি সব তলে নেমে আসে। কিন্তু কবরী প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। নিজের অভিনয়ে যেমন সারা জীবন নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, নিজের প্রথম নির্মাণেও তাঁর বোধের উত্তরণ ঘটেছে প্রজ্ঞার সুচারু সুনিপুণ দর্শনে; যা অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী।

এই চলচ্চিত্রে কবরী নিজেও অভিনয়ে একজন সুন্দর সমাজ গড়ার কারিগর। একজন মানবাধিকারকর্মী, নারী মুক্তি আন্দোলনের নেত্রী, সবার প্রিয় আফরোজা আপু, পেশায় আইনজীবী। গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি নারীদের পাশে দাঁড়ান। নারী নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করেন। নিজের অধিকার সম্পর্কে নারীদের সচেতন করেন।

সমাজের প্রতিটি শ্রেণি এবং বৃত্তের মানুষের সঙ্গে শুভ্র নামের এক তরুণ চিত্রশিল্পীর আলাপ হয়েছে। শুভ্র একটি প্রদর্শনী করবে বলে গ্রামে প্রকৃতির সান্নিধ্যে দৃশ্য আর মুখের অবয়ব খুঁজে বেড়ায়। কুসুম নামের গ্রামের এক কন্যাকে দেখে, সেই মুখ মনে মননে বোধে হৃদয়ে চেতনায় উজ্জীবিত হয়। বুকের ক্যানভাসে ধরে ছবি এঁকে ফেলে। কুসুম নদীর বুক ছুঁয়ে উঠে আসা সূর্যস্পর্শী সুন্দরী কন্যা। যদিও সে এই কন্যার নামধাম ঠিকানা পরিচয় জানে না।

কুসুমের বাবা মেয়েকে বোঝায়, যৌবনে তিনিও ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছিলেন। কুসুমের মাকে মনে ধরেছে। এক রাতের মধ্যে কাজি ডেকে বিয়ে করে বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। সেই মা কুসুমের বাবাকে ঠিক সংসারে বেঁধে ফেলেছে। কুসুম সেই মায়ের বীজ। রমিজকেও ঠিক সামলে নিতে পারবে। বাবার প্রেমের গল্প শুনে কুসুম বেশ মজা পায়। রমিজকে বিয়ে করতে অরাজি হয় না।

এবার চলচ্চিত্রের গল্পেও আমরা দেখব কুসুমকে ঘিরে, কুসুমকে নিয়ে ঘটনার আবর্তন।
কুসুম মাতৃহীন। বাবা আজম আলী হাটে–বাজারে, গ্রামের নানা অনুষ্ঠানে গান করে সংসার চালায়। কখনো হয়তো গাছে একটা কাঁঠাল ফলেছে, তা নিয়ে হাটে বিক্রি করতে ছোটে। কুসুমও খালার বাড়িতে কলসিতে জল দিয়ে এসে, এটা–ওটা কাজ করে দিয়ে দুমুঠো চাল পায়। বাপ-মেয়ের দুটি পেটের সংসার এভাবে চলে যায়।

কুসুমের সখী তুলির শ্যামলা বরন বলে বিয়ের সম্বন্ধ আর পাকা হয় না। যদিও শ্যামলা মেয়ের মেঘের মতো চুল, কালো হরিণ চোখ, কৃষ্ণকলি মুখের গড়ন রয়েছে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারে বাঁধা ওই চিরাচরিত পণপ্রথা। এবার যদিওবা পাত্রপক্ষ তুলিকে পছন্দ করল। বিয়ের দিন পণ হিসেবে একটা টেলিভিশন জোগাড় করতে না পারায়, পাত্রের বাবা ছেলেকে তুলে নিয়ে যেতে প্রস্তুত। কুসুমের বাবা আজম আলীর গান, কুসুম সখীদের নাচ, গ্রামের মহল্লার সবার বিনীত অনুরোধ কোনো কিছুতেই পাত্রের বাবার মন ভোলে না। কুসুম আগবাড়িয়ে পাত্রের বাবার মুখে মুখে তর্ক করে, তুলিকে তো কালো বানিয়ে পাঠিয়েছে আল্লাহ, আপনার ছেলের গায়ের রংও তো কালো। উচিত জবাব পেয়ে পাত্রের বাবা আরও রেগে যায়, কুসুমের বাবা কুসুমকে চড় কষায়। শেষমেশ অবশ্য গ্রামের এক দুষ্কৃতী যুবক রমিজের ভালোমানুষি আচরণে, মধ্যস্থতায় বিয়ে হয়। তুলির বাবা যেকোনো উপায়ে টেলিভিশন দেবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পণপ্রথা যে সামাজিক জীবনে কত বড় অভিশাপ, কবরী আরেকবার চাক্ষুষ করালেন।

রমিজ কুসুমের শরীরের লালসায় মজে কুসুমকে বিয়ে করতে চায়। বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। তার ভেতরের কদাকার রূপ তখনো কেউ জানত না। কুসুমের বাবা মেয়েকে বোঝায়, যৌবনে তিনিও ভবঘুরে বাউন্ডুলে ছিলেন। কুসুমের মাকে মনে ধরেছে। এক রাতের মধ্যে কাজি ডেকে বিয়ে করে বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। সেই মা কুসুমের বাবাকে ঠিক সংসারে বেঁধে ফেলেছে। কুসুম সেই মায়ের বীজ। রমিজকেও ঠিক সামলে নিতে পারবে। বাবার প্রেমের গল্প শুনে কুসুম বেশ মজা পায়। রমিজকে বিয়ে করতে অরাজি হয় না।

কিন্তু পাকা কথা দিতে আজম আলী রমিজের বাড়িতে গিয়ে দেখে সে ঘরবন্দী অন্য নারীকে বলাৎকার করছে। সেই নারী দরজা খুলে কাঁদতে কাঁদতে ছুটবে। রমিজ আজম আলীকে দেখতে পাবে। আজম আলী এ রকম অসৎ পাত্রের হাতে কন্যাকে আর কিছুতেই তুলে দিতে প্রস্তুত নয় জেনে, রমিজের প্রতিহিংসা চূড়ান্ত রূপ নেয়। সে আজম আলীকে হত্যা করে। রমিজের হাতে ধর্ষণের শিকার নারী আড়াল থেকে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে ফেলে। কিন্তু প্রাণভয়ে কাউকে কিছু বলে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর অবস্থান যে কতটা ভয়ের, আরও একবার তা দৃশ্যমান হয়।

রমিজ পাশে দাঁড়ানোর নাম করে বাবার কবরের পাশে ক্রন্দনরত কুসুমকে ধর্ষণ করতে চায়। কুসুম বাধা দিলে জানায়, সে কুসুমের বাবাকে হত্যা করেছে, রাজি না হলে কুসুমকেও হত্যা করবে। কুসুম এই ভয়ংকর দুষ্কৃতীর হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে কোনোরকমে ট্রেনে উঠে শহরে চলে আসে।
এক বাড়িতে চাকরের কাজ নেয়। সেই বাড়ির কর্তাও রাতে কুসুমকে ধর্ষণ করতে চায়। হরিণী নিজের মাংসে এভাবেই বারবার বৈরী হয়। এবার একা একা অসহায় শহরের রাস্তায় ত্রাতারূপে পোশাক কারখানায় কর্মরত কয়েকজন বন্ধুকে খুঁজে পায়। তারা এই অপরিচিত অসহায় একলা মেয়েকে মেসবাড়িতে নিয়ে আসে। মেসবাড়ির অন্য আবাসিক গার্মেন্টসের বড় কর্মকর্তা দোলনের সাহায্য নিয়ে কুসুমকেও পোশাক কারখানায় চাকরি দেয়।

দোলন একলা মানুষ। কুসুমের প্রেমে পড়ে। ধীরে ধীরে কুসুমেরও দোলনকে ভালো লেগে যায়। কুসুম এক বিক্রেতার কাছে আয়না তুলে নিয়ে নিজের মুখ দেখে। আয়নায় এই পিতৃ–মাতৃহারা, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে আসা জীবনপোড়া মুখ এখনো কত সুন্দর। দোলন সেই আয়না কিনে এনে কুসুমকে উপহার দেয়। আয়নায় দুই প্রেমিক কপোত–কপোতীর যুগল মুখ আরও সুন্দরতর। মেসবাড়ির বাড়িওয়ালা–বাড়িওয়ালি থেকে শুরু করে সবাই এই সম্পর্কের কথা জেনে যায়। মনে মনে গতিহারা একাকী দুটো নদীর মোহনায় মিলনের কথা ভেবে আনন্দ পায়।

কিন্তু মিলনের আগে আবার স্বপ্নের সাজানো বাগানে দৈত্যের হাতছানি লাগে। রমিজ শহরে এসে কুসুমকে খুঁজে পায়। আবার কুসুমকে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। পোশাক কারখানার অন্য এক কর্মী খালেককে সঙ্গে নিয়ে কুসুমের মেসবাড়িতে চড়াও হয়। এই খালেক আবার পেশাগত কারণে দোলনের প্রতিদ্বন্দ্বী।
রমিজ বাড়িওয়ালাসহ সবাইকে বোঝায় কুসুম তার বিয়ে করা বউ। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। সে সময় সেখানে এসে হাজির হয় মানবাধিকারকর্মী আফরোজা। কুসুম সবাইকে বলে রমিজ মিথ্যা বলছে। আফরোজা কুসুমকে নিজের হাতে নেয়। সত্য উন্মোচনের জন্য পুলিশে ডায়েরি করে। রমিজকে প্রমাণ নিয়ে আসতে বলে।

রমিজ কুসুমকে বিয়ে করার প্রমাণ আনতে পারে না। পারস্পরিক ভুল–বোঝাবুঝি দূর হয়ে কুসুম আর দোলনের বিয়ের বাদ্য বেজে ওঠে। দুটি প্রেম পরিণতি পায়। বাসররাতে রমিজ এসে কুসুমের মুখে অ্যাসিড ছুড়ে মারে। নারীর ওপর সর্বগ্রাসী সহিংস নির্যাতনের ঘুণ ধরা পচনশীল সমাজের অন্য এক ভয়ংকর দিক উঠে আসে। রমিজকে এই জঘন্য কাজে সাহায্য করে খালেক। দগ্ধ পোড়া মেয়ের চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এসে দুই বদমাশকে ধরার চেষ্টা করে। নানা কারণে পেরে ওঠে না।

হাসপাতালে জীবন–মরণ যুদ্ধ শুরু হয় কুসুমের। আফরোজা কাগজে খবর করে দেয়। পুলিশ অপরাধীকে খুঁজে বের করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সবার তৎক্ষণাৎ তৎপরতায় কুসুম প্রাণে বাঁচে। কিন্তু আয়নায় নিজের পোড়া দগ্ধ মুখ দেখে নিজেই ভয় পায়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, আত্মহত্যা করতে ছোটে। দোলন তাকে বাঁচায়।
আফরোজা বিদেশে পাঠিয়ে প্লাস্টিক সার্জারি করার উদ্যোগ নেয়। সবাই মিলে টাকা জোগাড় করে। শিল্পসাধক চিত্রকর শুভ্রও নিজের ছবি বিক্রির টাকা কুসুমের জন্য তুলে দেয়। এভাবে পচনশীল সমাজের ভিন্ন এক মুখ, সুস্থ সুন্দর সমাজ গঠনে সবার দায়বদ্ধতার পরিচয় মেলে।

অপরাধী ধরা পড়ে। নির্যাতিতার পক্ষে সরাসরি লড়াই করে আইনজীবী আফরোজা। সব সাক্ষ্যপ্রমাণ সাপেক্ষে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের চূড়ান্ত সর্বোচ্চ শাস্তিস্বরূপ রমিজ আর খালেকের ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হয়। বিদেশ থেকে কুসুম আবার পুরোনো রূপ, পুরোনো সূর্যস্পর্শী মুখ নিয়ে ফিরে আসে। তৃষ্ণার্ত বিরহী চাতক, বিরহিনী চাতিকা দোলন কুসুমকে বুকে টেনে নেয়। শুভ্র চিনতে পারে এই মুখ সেই মুখ, যে মুখের ছবি একদিন সে হৃদয়ের ক্যানভাসে ধরেছিল। এই মুখ সেই মুখ, যা নিষ্পাপ, যাতে কোনো মিথ্যা লেগে নেই। এই মুখ সৃষ্টি করার আনন্দে শিল্পীর জীবন সার্থক। এভাবে জীবন-শিল্প-সৃজন, মন-মনন-প্রেম যুদ্ধ আর যুদ্ধজয়ের শেষে পরিতৃপ্তি, বিজয়ের আনন্দ এক হয়ে যায়।

কবরীর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের যুদ্ধ সার্থক হয়। শিল্প–নান্দনিক গঠনের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করে। কুসুম চরিত্রে সোহানা সাবা কিংবদন্তি কবরীর হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রজগতে ইতিহাসের তারা বিন্দু হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। তাঁর মিষ্টি আদুরে কণ্ঠ, মিষ্টি রূপ ক্যামেরা যথাযথ ধরতে পেরেছে। সাবলীল অভিনয়ে দোলন ফেরদৌসও চমৎকার। সুভাষ দত্ত, এ টি এম শামসুজ্জামান, রানী সরকার, জ্যোতিকা জ্যোতি, জয়রাজ সবার অভিনয় প্রাণবন্ত। এ টি এম শামসুজ্জামান সংলাপে–অভিনয়ে বাড়িওয়ালা চরিত্রে আনন্দধারা বইয়ে দেন। এই চলচ্চিত্রে সংলাপ লিখেছেন আখতারুজ্জামান। গান বুনেছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। সুর পরিচালনা করেছেন ইমন সাহা। আর নবাগত প্রত্যেকের অভিনয় থেকে শুরু করে, পোশাক পরিকল্পনা পর্যন্ত সব দিকে কবরীর সূক্ষ্ম নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় মেলে।

একটি কুসুমের জয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে হাজার হাজার কুসুমের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন কবরী। যবনিকা পতনের অন্তে সবার জন্য তাই বার্তা লেখা থাকে, ‘কুসুমরা বাঁচার স্বপ্ন দেখে। ওরা বাঁচতে চায়।’

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত