শিল্পী থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প ‘রক্তাক্ত বাংলা’

‘রক্তাক্ত বাংলা’ চলচ্চিত্রের পোস্টারছবি: সংগৃহীত
তেমনই এক ভাস্কর্যশিল্পীর কথা, শিল্পী থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প বলে যায় রক্তাক্ত বাংলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক বছর পরে, ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের গল্প লিখেছেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। চিত্রনাট্য ও সংলাপ বুনেছেন শান্তি কুমার চট্টোপাধ্যায়। পরিচালনায় মমতাজ আলী। এই চলচ্চিত্রে ‘ও দাদাভাই, দাদা ভাই মূর্তি বানাও…’ গানটি করে বাংলাদেশের বুকে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর।

একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা; মানুষের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে নির্দয় নির্মম শাসন-শোষণ জারি করে রেখেছে। মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা, মানুষের মুখে রক্ত ওঠা এই কারাগারের অচল হয়ে যাওয়া আয়তনটাকে এবার ভাঙতে হবে। এত বড় এই পাথরটাকে শিল্পী ধ্বংস করে নতুন একটা শৈল্পিক রূপ দেন। পাথরের ভেতরে প্রাণ জাগ্রত করে মানুষের মুখের আদলে মানুষ গড়ে তোলেন। একটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শিকলমুক্ত করে মাটির ওপরে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে শেখান। এখানেই শিল্পীর মুক্তি। শিল্পসত্তার মুক্তি।

তেমনই এক ভাস্কর্যশিল্পীর কথা, শিল্পী থেকে যোদ্ধা হয়ে ওঠার গল্প বলে যায় রক্তাক্ত বাংলা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক বছর পরে, ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। চলচ্চিত্রের গল্প লিখেছেন রত্না চট্টোপাধ্যায়। চিত্রনাট্য ও সংলাপ বুনেছেন শান্তি কুমার চট্টোপাধ্যায়। পরিচালনায় মমতাজ আলী। এই চলচ্চিত্রে ‘ও দাদাভাই, দাদা ভাই মূর্তি বানাও…’ গানটি করে বাংলাদেশের বুকে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিয়েছেন সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর। হাসি নামের এক বোনের কণ্ঠে এই গান। হাসি চরিত্রে অভিনয় করেছেন মিষ্টি সুলতানা। তাঁর দাদা শাহেদ চরিত্রে বিশ্বজিৎ, একজন ভাস্কর। পাথর কেটে মূর্তির রূপ দেন।

দাদার বানানো অপরূপ সব মূর্তি দেখে ছড়া কেটে কেটে গান ধরেন বোন। একটা শৈল্পিক আবহে, শিল্পের পরিমণ্ডলে ভাইবোনের সংসার ভালোই চলছিল। একদিন শাহেদের সৃষ্টিঘরে এসেছিল সন্ধ্যা নামের একটি মেয়ে। অভিনয়ে কবরী।  যাকে দেখলেই জয় গোস্বামীর বিখ্যাত চরণ মনে পড়ে যায়, ‘ওই মেয়েটির কাছে সন্ধ্যাতারা আছে।’ সন্ধ্যা নিজেও শিল্পী। নাচ, গান করে, মূর্তি গড়তে পারে। সেই সৃষ্টিসুখের টানেই অন্য স্রষ্টার সৃষ্টিঘরে আসা। মূর্তি দেখতে দেখতে হঠাৎ হাত থেকে একটা মূর্তি পড়ে ভেঙে যায়। শিল্পী শাহেদ রেগে গিয়ে সন্ধ্যাকে একটু কঠিন কথা বলেন। সন্ধ্যার চোখে জল চলে আসে। এখানেই চার চোখের একটা মেঘ বৃষ্টির মিলন হয়।

মুক্তির ডাকে সংগ্রাম ঘনিয়ে আসে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের বিশ্ব ইতিহাসের পাতার সেই ভয়ংকর কালরাত। পাকিস্তানের বর্বর সেনারা দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, ছাত্র সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করতে থাকে। শাহেদের সৃষ্টিঘরে ঢুকে জীবন্ত সব মূর্তিগুলোকে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে এবং হাসিকে হত্যা করে। শিল্পী শাহেদ বিবস্ত্র বোনের শরীর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়। বোনের রক্তাক্ত মুখের সামনে দাঁড়িয়ে উন্মাদ হয়ে ওঠে। বোনের মুখে গোটা দেশের মুখ দেখতে পায়। এবার তাই অশ্রুকে আগুনে পরিণত করার পালা। যে হাতে মানায় বাঁশের বাঁশরী, সেই হাতে রণতূর্য, অস্ত্র তুলে নেওয়ার পালা।

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে শিল্পী শাহেদ ক্যাপ্টেন শাহেদ হয়ে ওঠেন। গেরিলা বাহিনী নিয়ে একের পর এক আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানিরা কীভাবে নারীদের ওপর অত্যাচার চালায়, মুক্তিযোদ্ধারা নারী সহযোদ্ধাদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে কীভাবে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে, এসব দৃশ্য এই চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। এই চলচ্চিত্রে উন্মাদ নারী মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধা বলে আমি পাকিস্তানি নই, দেশকে রক্ষা করি। নারী বলে ওঠে, তবে আমার স্বজনকে ফিরিয়ে দাও। আমার সম্মান–ইজ্জত ফিরিয়ে দাও। লাখ লাখ শহীদ, মা-বোনের সম্মানের বিনিময়ে যে আজকের স্বাধীনতা, এই ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অসহ্য যন্ত্রণার কথা মনে করিয়ে দেয় এই চলচ্চিত্র।

যুদ্ধ শেষ হয়। ক্যাপ্টেন শাহেদ একটি বাড়ির ভেতর থেকে এক নারীর আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসতে শোনেন। বন্দুক তাক করে সেই বাড়িতে গিয়ে ঢোকেন। রহস্যের অবসান হয়। সন্ধ্যাকে দেখে সে চিনতে পারে। সন্ধ্যার দাদা ডা. মাসুদ, অভিনয়ে গোলাম মুস্তাফা, যোদ্ধাদের চিকিৎসা করে গেছেন। তিনি জানান, বোন সন্ধ্যা পাকিস্তানি সেনাদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।

শাহেদকে সামনে দেখার পর থেকে ধীরে ধীরে সে সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে। শাহেদ অস্ত্র ছেড়ে আবার শিল্পী হয়ে ওঠেন। মূর্তির ভেতরে বোনের মুখ ফুটে ওঠে। সেই যে বোন গাইতো, ‘ও দাদা ভাই; দাদা ভাই মূর্তি বানাও/ নাক মুখ চোখ সবই বানাও/ হাতও বানাও, পা–ও বানাও/ বুদ্ধ যিশু সবই বানাও, মন বানাতে পারো কি?/ একটা ছোট বোন বানাতে পারো কি?’ এবার সত্যি সত্যি মূর্তির শরীরে মন বানায়, মূর্তির শরীরে বোনকে বানায়।

এই মূর্তি দেখে সন্ধ্যা ভাবে, এ এক অন্য কোনো নারী। শিল্পী মনে বাসা বেঁধে আছে। শাহেদের প্রতি সে অনুরক্ত। তাই অন্য নারীকে মেনে নিতে পারে না। একসময় সে জানতে পারে, এই মূর্তি হলো শাহেদের বোন হাসি। এই ভুল বোঝাবুঝির বোঝা মাথায় নিয়ে এবার তাই সন্ধ্যা আত্মহত্যা করতে যায়। শাহেদ গিয়ে তাঁকে বাঁচায়। মুক্তিযুদ্ধের বীভৎস কালো দিনগুলো পেরিয়ে একটা ইতিবাচক ইঙ্গিতপূর্ণ স্বপ্নের বুননে এই চলচ্চিত্র শেষ হয়। শেষে লেখা থাকে, ‘শেষ নয় শুরু’।

চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন সলিল চৌধুরী। লতা মঙ্গেশকর ছাড়াও গান করেছেন মান্না দে, সবিতা চৌধুরী। মৃত বোনের রক্তাক্ত মুখ অশ্রুসজল শিল্পী যখন তুলে ধরে, বোনের কণ্ঠে পুরোনো গানের অংশ ভেসে আসে, ‘আমি তো চিরদিন কাছে রবো না/ যাব যে সুদূরে খুঁজে পাবে না/ ঝন ঝন ঝন আঁচলে মোর ঘরেরই চাবি/ নেবে যে ভাবী/একটা উপায় বলো না’ এই দৃশ্য হৃদয় বিগলিত করে দেয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চারদিক যখন অগোছালো, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশে দাঁড়িয়ে অতি স্বল্প পরিসরে এ ধরনের একটা মুক্তিযুদ্ধের ছবি বানানো, এ বড় কঠিন কাজ। এই কাজও পাথর কেটে মূর্তি তুলে আনার মতো।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত