প্রশ্ন তোলে জন্মসাথিরা

‘জন্মসাথী’ প্রামাণ্যচিত্রের একটি দৃশ্যছবি: সংগৃহীত

নিজেকে খোঁজার চেয়ে বড় শিল্প, বড় সৃষ্টি অন্য কিছু হয় না। আমরা সারা জীবন দেশ–দুনিয়া তন্নতন্ন করে কত কিছু খুঁজে বেড়াই, নিজের ভেতরে নিজেকে শুধু সেভাবে খুঁজে বেড়ানো হয় না। আত্মমুখী দর্শন, শিকড়ের সন্ধান একটা অতল পৃথিবীতে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে আমার আমি থেকে দেখা যায় অসংখ্য আমি প্রতিনিয়ত ভিড় করে করে আসে। তাদের কতজনের ভেতরে কত রকমের আত্মপরিচয়ের সংকট। কত রকমের শোক তাপ গ্লানি, যা আসলে আমাকেই সেই নির্মম সত্যের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করাতে সাহায্য করে।

ক্ষুদ্র আমি থেকে বৃহৎ আমি, চারপাশের সমাজ রাষ্ট্র পরিবার সবার দিকে গভীর প্রশ্নের পর প্রশ্নের তির ছুড়ে দেয়। উত্তরের খোঁজে আমাকেই আবার নিয়ত মিলিয়ে যেতে হয়। শবনম ফেরদৌসী তেমনই একজন আত্মানুসন্ধানী। নিজের জন্ম সত্যের সন্ধানে অতলে গিয়ে জন্মসাথিদের খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। নিরলস প্রচেষ্টায় তাঁদের খুঁজে বের করে বৃহত্তর সত্যের সন্ধানে, গোটা একটা দেশ আর জাতির সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন।

তরুণ প্রামাণ্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক শবনম ফেরদৌসী, মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে একটা ধ্বংসস্তূপের পৃথিবীতে যাঁর জন্ম। শত ভঙ্গ বঙ্গদেশে বিজয় এসেছে ঠিকই, রাষ্ট্র ভেঙে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। কিন্তু শোক যন্ত্রণা রক্তক্ষয় ত্যাগ—এসব তো সহজে মেলানোর নয়। মেলানোর নয় যুদ্ধের ময়দানে নারীর আত্মবলিদান। নারী অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে আবার ভোগ্যসামগ্রী হয়ে নরপশুদের লালসা মেটাতে হয়। যে নারীর গর্ভে ভালোবাসার সন্তান আসে, সেই নারীর গর্ভে ধর্ষণ যৌনপীড়ন নির্যাতনের বীজ রোপিত হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের পাশে লাখ লাখ এমনই সব বীরাঙ্গনা নারীর রক্ত অশ্রু সম্ভ্রমের ইতিহাস জড়িয়ে আছে। পাকিস্তানি নরাধম বর্বর সেনারা, দেশের মাটির বেইমান রাজাকার পশুরা লাখ লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে। ধর্ষণের পর মেরে ফেলেছে। করালগ্রাস থেকে যাঁরা বেঁচে ফিরেছেন, গর্ভে তাঁদের এসেছে ধর্ষণ–জারিত সন্তান। লোকলজ্জা ভয়ে অসংখ্য নারী আত্মহত্যা করেছেন। কেউ গর্ভপাত করিয়ে কলঙ্ক মোচন করতে চেয়েছেন। আর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর থেকে এখানে–ওখানে জন্ম নিতে শুরু করেছে নিষ্পাপ ফুলের মতো যুদ্ধজাত সন্তানেরা। নির্যাতিত মায়ের মতো এই নবজাত শিশুদেরও কোনো দোষ নেই। কিন্তু নবগঠিত রাষ্ট্র ঠিক কী করল? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ যা করে, সেই সব নারীকে একঘরে করা হলো। নবজাত অসংখ্য শিশুকে বাইরের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। হতভাগ্য কেউ কেউ স্বাধীন দেশের মাটিতে আত্মপরিচয় গোপন করে বেঁচে রইল না-বেঁচে থাকার মতো। দেশের স্বাধীন মানুষ শত্রুপক্ষকে কাছে না পেয়ে এই নিরপরাধ শিশুদের শত্রুসন্তান ভেবে নিয়ে তত দিনে অত্যাচার করতে শুরু করে দিয়েছে।

শবনমের জন্ম ১৯৭২ সালে। শবনম মায়ের মুখে শুনেছে, একই দিনে হাসপাতালে ১৩ জন শিশু জন্ম নিয়েছিল। যাদের মধ্যে চার–পাঁচজন নির্যাতিত মায়ের যুদ্ধসন্তান ছিল। নিজের শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়ে, পরিণত সৃষ্টিশীল জীবনে এসে শবনম সেই জন্মবন্ধু যুদ্ধশিশুদের খুঁজতে শুরু করলেন। কিন্তু কোনো হাসপাতালে, কোনো সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধশিশুদের জন্মের কোনো নথি নেই। প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সে সবকিছু কালের অতলে মিলিয়ে ফেলেছে। কোনো সত্য, কোনো প্রমাণ কোথাও রাখেনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সেসব পুনর্বাসন কেন্দ্রও অচল হয়ে গেছে। হাজার হাজার যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্র গা ঝেড়ে ফেলেছে, তাঁদের আর কোনো খোঁজ রাখেনি। দেশের মাটিতে যাঁরা ঘাস লতা ফড়িংয়ের সঙ্গে বেড়ে উঠেছে লাঞ্ছনা তাঁদের নিত্যসঙ্গী।

দীর্ঘদিন ধরে খোঁজ করার পর শবনম তিনজন যুদ্ধশিশুকে প্রামাণ্যচিত্রে তুলে আনতে পেরেছেন। সুধীর ও শামসুন্নাহার দেশের মাটিতে যাঁরা ছিলেন আর মনোয়ারা ক্লার্ক বাইরের দেশে বেড়ে উঠেছেন। সুধীরের পরিবারের লোক নিজেরা বাঁচার জন্য সুধীরের মাকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। গর্ভে সন্তান এসেছে জানার পরেও সুধীরের দাদু মেয়ে ও নাতিকে ফেলে দেননি। অন্যদিকে শামসুন্নাহারের পরিবারের লোকও তাঁর মাকে ঘরে তুলে নিয়েছিলেন। এ ধরনের মহৎ উদার পরিবারগুলো ছিল বলেই না এই নবজাতকেরা নিজের ভূমিতে কোনোরকম বেড়ে উঠতে পেরেছে।

সাদাসিধা সুধীর এখন ভ্যান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাঁর একটা মেয়ে আছে। সেই মেয়েও দেশের জন্য আত্মবলিদান দিতে প্রস্তুত। তবে শামসুন্নাহারের এখনো কোথাও ঠাঁই নেই। নিজের মায়ের পেটের পরবর্তী সময়ের ভাই তাকে মেরে ফেলতে চায়। লোকচক্ষুর আড়ালে তাই তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান। অন্যদিকে কানাডাপ্রবাসী মনোয়ারার প্রশ্ন, কেন দেশ তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল? স্বামীর সঙ্গে এখন বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁর। তিনি সুখে নেই। জন্ম থেকেই ছন্নছাড়া এসব জীবন এখনো যেন কালের স্রোতে পানার মতো ভেসে চলেছে মাত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চারদিকে এত বীরগাথা লেখা রয়েছে, এই নিপীড়িত নারীদের কথা, তাঁদের অসহায় সন্তানদের কথা কেউ সেভাবে কখনো ভাবেনি। কেউ পাশে এসে দাঁড়ায়নি।

শবনম নিজের ভেতরে অনবরত তাড়া খেয়ে এই প্রান্তিক স্বরের পেছনে ছুটেছেন। আরও কিছু যুদ্ধশিশুর খোঁজ পেলে, তাঁদের জীবনের গল্প তুলে ধরতে পারলে হয়তো ভালো হতো। কিন্তু খুঁজে পাবেন কোথায়? সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আড়াল যে এখনো ঘোচেনি। এই তিনজন তো হাজার হাজার শিশুর প্রতিনিধি মাত্র।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। কত নারী, কত শিশু যে তারপরেও হারিয়ে গেছে। সেই বলীদানের শহীদবেদি হয় না। শবনমের জন্মসাথিরা এই পৃথিবীর অযাচিত সন্তান। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের যন্ত্রণা এবং কাঁটা। একটা স্বাধীন জাতির ধ্বংসস্তূপে কীটদ্রষ্ট আলো। মুক্তিযুদ্ধের মুক্তি কোথায়? প্রশ্ন তোলে এই জন্মসাথিরা। উত্তর খোঁজার দায় আমাদের।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত