সত্যেন সেন রচিত ‘বিদ্রোহী কৈবর্ত’ একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষের সংগ্রামের ওপর রচিত এই উপন্যাসে রাজনীতির নানা কৌশল, মানুষের সামাজিক বন্ধন, অন্যায়ের প্রতিবাদে মুক্তির লড়াই ইত্যাদি অনেক কিছু উপস্থাপিত হয়েছে।
এই উপন্যাসের মহানায়ক বলা যায় দিব্যক সামন্তকে, যিনি নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা, রাজনৈতিক কৌশল, নানা সম্প্রদায়ের সমন্বয় করে দীর্ঘদিনের অত্যাচারিত রাজা থেকে রাজ্য মুক্ত করে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষের স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন।
গৌড়ের স্বর্গীয় মহারাজ বিগ্রহপালের ছেলে রামপালের সময় মানুষ নানাভাবে অত্যাচারিত হতো। হিন্দু আর বৌদ্ধদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল নিত্যদিনের বিষয়। রাজা বৌদ্ধ হলেও রাজ্যে হিন্দুধর্মের প্রভাব বেশি পড়ত। এর পেছনে অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন রাজ্যের প্রধান অমর্ত্য তীক্ষ্ণ কূটবুদ্ধি সম্পূর্ণ বরাহস্বামী। রাজা মহীপাল শুধু নামেই রাজা ছিলেন, যেহেতু সব আদেশ এই বরাহস্বামীই ঠিক করতেন। রাজাও কিছু বলতেন না। কারণ, তাঁর রাজা হওয়ার পেছনে এই ব্যক্তির ভূমিকা ছিল অনেক।
স্বর্গীয় মহারাজ বিগ্রহপালের পট রানি রাষ্ট্রকূটনন্দিনী শঙ্খ দেবী সব সময় চাইতেন তাঁর ছেলে রাজা হোক। সে কারণে যত রকম ষড়যন্ত্র করার প্রয়োজন, তিনি করেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। বরাহস্বামী রাজ্য রক্ষার্থে নিয়ম অনুসারে রাজার বড় ছেলে কুমার রামপালকেই রাজা করলেন। শঙ্খ দেবীর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির কথা রাজ্যপ্রাসাদের সবাই জানতেন। কিন্তু শেষে যখন তিনি ধরা পড়লেন এবং রাজা পরাজিত হওয়ার পর রাজবৈদ্য হরিগুপ্তের সঙ্গে জীবনের শেষ কয়েকটা বছর কাটালেন, তখন রাজমাতা শঙ্খ দেবীর অন্য রূপ প্রকাশিত হলো। দীর্ঘদিনের জমে থাকা প্রেম প্রকাশ পেল, যা রাজ্যের কড়া শাসনকে অতিক্রম করে তিনি ভেবেছিলেন। সরলমনা রাজবৈদ্য হরিগুপ্ত সব বুঝেও দূরে সরে থাকতেন। শেষে আর পারলেন না। প্রকৃতির কাছে তাঁকে আত্মসমর্পণ করতেই হলো। জীবনের শেষ সময়ে শঙ্খ দেবীর সঙ্গে তাঁর দিনগুলো ভালো কেটেছিল।
মহাসান্ধিবিগ্রহিক পদ্মনাভের সরলতা, সৎ উদ্দেশ্য, বিচক্ষণক্ষমতা সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আলো ছড়িয়েছিল। কৈবর্ত বিদ্রোহের পর তিনি বেঁচে থাকলে হয়তো সে আলো আরও প্রসারিত হতো। কিন্তু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দাবানলে তাঁকে শত্রুর হাতে প্রাণ দিতে হলো।
সামন্ত দিব্যকের অবদান এই কৈবর্ত বিদ্রোহে প্রবল ভূমিকা রেখেছিল। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তিনি নানা কৌশল খাটিয়ে অর্জিত জ্ঞান দিয়ে সবার সঙ্গে সমানতালে সমন্বয় রেখে সম্পর্ক চালিয়ে গেছেন। একদিকে যেমন করে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের একত্র করে শক্তিশালী করে তুলেছিলেন, তেমনিই নিকটবর্তী পীঠিরাজের রাজা দেব রক্ষিতসহ বিভিন্ন রাজার সঙ্গে সহায়তার জন্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছিলেন। এতই সুকৌশল তিনি করেছিলেন যে দুই পক্ষের লোকের সঙ্গেই তাঁর চলাফেরা ছিল এবং দুই পক্ষই তাঁকে বিশ্বাস করত। যার ফলে বরাহস্বামীর মতো এমন তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন লোকও তাঁকে চিনতে পারেননি। যুদ্ধের ক্ষণকাল আগেও কেউ বুঝতে পারেননি যে, রাজ্যপত্তনের এই মহাযুদ্ধের মহানায়ক দিব্যক সামন্ত।
দিব্যককে কৈবর্ত সম্প্রদায়ের লোকেরা মনুষ্য দেবতা বলে মানতেন। একমাত্র এই ব্যক্তির কথা কেউ ফেলতে পারতেন না। তিনি পছন্দ করেন না বলে দীর্ঘ বছরের উলান ঠাকুরের পূজায় নরবলিপ্রথা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা। কারণ, দীর্ঘদিন পর এই দিব্যকের সাহসিকতার জন্যই যুদ্ধ জয় করে তাঁরা স্বাধীনতা পেয়েছেন। সুন্দর শান্তিময় জীবন যাপন করছেন।
এত যুদ্ধবিগ্রহ, জল্পনা-কল্পনা, মন্ত্রণার মধ্যে রাজমাতা শঙ্খ দেবী আর রাজ্যবৈদ্য হরিগুপ্তের শেষ জীবনে প্রেমকাহিনি গল্পে নতুন রস যোগ করেছে। যুদ্ধ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, ষড়যন্ত্র ইত্যাদির মধ্যেও নিঃস্বার্থ মানবসেবা আর মনের প্রেমের অন্যতম উদাহরণ ছিল এই দুই ব্যক্তি ও তাঁদের বর্ণনাতীত দিনগুলো।
যে সমাজের মানুষের মুক্তির জন্য দিব্যক সামন্ত লড়াই করলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই তাঁর বিরোধী ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর অনেক আগেই তাঁকে কেউ একজন বিষমাখা তির দিয়ে মারার চেষ্টা করেছিলেন। তাৎক্ষণিক কিছু না হলেও এই তিরের বিষক্রিয়া চলতে থাকল দীর্ঘদিন এবং এই সাহসী মহানায়ক দিব্যক ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে লাগলেন। মৃত্যুক্ষণ যখন ঘনিয়ে এল, তখন দিব্যক জানতে পারলেন সেই বিষমিশ্রিত তির–ধনুকের ব্যক্তি সম্পর্কে। কৈবর্তদের বাৎসরিক উৎসবের দিন শত্রুরা রাজ্য আক্রমণ করলে, যে যুবক সাহসিকতার সঙ্গে কৈবর্তদের রক্ষা করেছিল, সেই আকনই তাঁকে বিষমিশ্রিত তির ছুড়েছিলেন, যা তিনি নিজে এসে একাকী ঘরে দিব্যকের সামনে স্বীকার করেছিলেন। দিব্যক তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। ক্ষমার ইতিহাস দীর্ঘায়িত হলো।
একনজরে
বই: বিদ্রোহী কৈবর্ত
লেখক: সত্যেন সেন
প্রকাশক: কে এম ফিরোজ খান
প্রকাশনী: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
প্রথম প্রকাশকাল: বইমেলা ২০০৮
প্রচ্ছদ শিল্পী: সমর মজুমদার
মুদ্রণ: মৌমিতা
মূল্য: ২০০ টাকা
সাবেক সাধারণ সম্পাদক, নরসিংদী বন্ধুসভা