বৃষ্টিমুখর দিনে ধূপপানি ট্রেইল—রোমাঞ্চ থেকে বেশি কিছু

বিলাইছড়ি থেকে ধূপপানি যাওয়ার পথে সেনাবাহিনীর প্রথম ক্যাম্পে ছবি তোলা।

ঘড়ির কাঁটায় বেলা তখন তিনটা। আকাশ মেঘলা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, মাঝেমধ্যে বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। সকাল থেকেই এমন গুমোট পরিবেশ। আমরা বসে আছি উলুছড়িতে কর্ণফুলী নদীর তীরে নোঙর করে রাখা ট্রলারের ভেতর। ওপরে ছাদ থাকায় ভেতরে বৃষ্টির পানি প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে ট্রলারে আমরা সাতজন। এর মধ্যে তিনজন সকাল ১০টা থেকেই রয়েছে। আমিসহ বাকি চারজন কিছুক্ষণ আগে ধূপপানি ঝরনা থেকে দেড় ঘণ্টার ট্রেকিং করে এসে পৌঁছাই। অপেক্ষা দলের অন্য সদস্যদের জন্য।

বিকেল চারটার মধ্যে উলুছড়ি থেকে বিলাইছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যেতে হবে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা নদীপথে আড়াই-তিন ঘণ্টার দূরত্ব। পথিমধ্যে সেনাবাহিনীর দুটি ক্যাম্প রয়েছে। দুটিতেই চেক পয়েন্ট। নিরাপত্তার শঙ্কায় চারটার পর এই এলাকায় পর্যটকদের থাকার সুযোগ নেই। উলুছড়িতে কোনো সিমের নেটওয়ার্কও নেই। সকাল থেকেই বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন আমরা। এদিকে আকাশ মেঘলা থাকায় বেলা তিনটাতেই মনে হচ্ছে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আশপাশে পর্যটকদের আরও কয়েকটি ট্রলার রয়েছে। সেগুলো একে একে বিলাইছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে।

আমরা মোট ২৭ জন। এর মধ্যে ২৪ জন ধূপপানি ঝরনায় যাই। ভোর ছয়টায় বিলাইছড়ি থেকে রওনা দিয়ে সকাল নয়টায় উলুছড়ি এসে পৌঁছাই। ট্রলারেই সকালের নাশতা সেরে ট্রেকিংয়ে যাওয়ার জন্য দুজন গাইড ঠিক করা হয়। পর্যটকদের আরও কয়েকটি দল রয়েছে।

সময়টা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। কয়েক দিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে। এ এলাকায় খুব বেশি মানুষের বসবাস নেই। চারপাশে পাহাড় ও পাহাড়ি জঙ্গল। যত দূর চোখ যায়, মাঝেমধ্যে পাহাড়ের ওপর দু-একটা বাড়ি দেখা যায়। কাঠ ও বাঁশের তৈরি এসব বাড়ি। স্থানীয় মানুষের জন্য উলুছড়িতে কেবল একটি দোকান রয়েছে। গাইডদেরও সেখান থেকেই ঠিক করতে হয়। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি মাটি ভয়ংকর রকম পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে আছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমাদের ট্রেকিং শুরু।

ধূপপানি ঝরনায় যাওয়ার পথের ট্রেইল। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি পথ ভয়ংকর রকম পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে আছে।

প্রথমে ছোট ডিঙিনৌকায় করে পাহাড়ি ঢলের পানির কারণে সৃষ্টি হওয়া জলাশয় পাড়ি দিতে হয়। ছয়-সাত মিনিটের মতো সময় লাগে জলাশয় পাড়ি দিতে। তারপর আঁকাবাঁকা কর্দমাক্ত পথ ধরে হাঁটা। কোথাও কোথাও হাঁটুসমান কাদামাটি। ট্রেকিংয়ের জন্য উপযোগী জুতা সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াটা উত্তম, অথবা ভালো মানের অ্যাংলেট। আর নিজের ভর সামলানোর জন্য একটি করে বাঁশের লাঠি। দোকানেই লাঠি পাওয়া যায়। আমি পায়ে অ্যাংলেট পরি, তবে কোনো লাঠি সঙ্গে নিইনি। নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস ছিল। অন্য সবাই সঙ্গে করে লাঠি নেয়। দুই-আড়াই ঘণ্টার ট্রেকিং। প্রথম ৪০-৫০ মিনিট সমতল। এরপর শুরু হয় পাহাড়ি রাস্তা। মোট তিনটি বড় বড় পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। পিচ্ছিল হয়ে থাকায় প্রতিটি পদক্ষেপে খুবই সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছিল। মনোযোগ হারালেই দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। পথে অনেকগুলো ঝিরি পড়ে। আমাদের সামনে একজন ও পেছনে একজন গাইড ছিল। গাইড ছাড়া এই ট্রেকিংয়ে না যাওয়াটাই সবচেয়ে ভালো।

দুই ঘণ্টার মধ্যেই ধূপপানি পাড়ায় পৌঁছে যাই। পুরো পথের মধ্যে কেবল এ পাড়াতেই কিছু মানুষের বসবাস চোখে পড়ল। সেখানে মিনিট দশেক বিশ্রাম নিই। পাহাড়ি কলা খাই ও পানি পান করি। আবার হাঁটা শুরু। ধূপপানি ঝরনায় যেতে আরও ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগে। পুরো পথের মধ্যে এই দূরত্বের পথটা সবচেয়ে ভয়ংকর। আঁকাবাঁকা পথ ধরে অন্তত ২০০ মিটার নিচে নামতে হয়। তারপরই দেখা মেলে অসম্ভব সুন্দর জলপ্রপাতের। ঝরনায় পৌঁছাতে বেলা প্রায় একটা বেজে যায়।

ধূপপানি ট্রেইলে এমন পাহাড়ি ঝিরি পথ পাড়ি দিতে হয়। দুই-আড়াই ঘণ্টার ট্রেকিং।

আধা ঘণ্টার মতো সেখানে ছিলাম। পর্যটকদের অন্য দলগুলো এরই মধ্যে ফিরে আসা শুরু করে দিয়েছে। আমরাই সবার শেষে ফেরার পথ ধরি। ঘড়িতে তখন দেড়টা বাজে। দেখলাম দলের অন্যরাও ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এবার এত দ্রুত হেঁটেছিলাম যে মাত্র দেড় ঘণ্টায় ট্রলারে চলে আসি। দ্রুত হাঁটার ফলে অন্যরা পেছনে পড়ে যায়। আমরা কর্ণফুলী নদীতে গোসল সেরে তৈরি হয়ে ট্রলারে বসে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

প্রায় এক ঘণ্টা আর কারও দেখা নেই। বিকেল চারটার দিকে আরও কয়েকজন এসে পৌঁছায়। তখন আমাদের ট্রলারের পাশাপাশি আরও একটি ট্রলার নোঙর করা ছিল। বাকি ট্রলারগুলো এরই মধ্যে ফিরে চলে গেছে। সাড়ে চারটার দিকে দলের আরও কয়েকজন এসে পৌঁছায়। ততক্ষণে পাশের ট্রলারটিও চলে যায়। এবার আমরা একা। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দলের আরও ১১ জন সদস্য এসে পৌঁছাতে বাকি। ঘড়িতে সময় কেবল বাড়তে থাকে। কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই।

ওই দিন রাতেই আমাদের ঢাকায় ফেরার কথা। রাত ১১টায় চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনের টিকিট কাটা। নিয়ম অনুযায়ী রাত আটটার মধ্যে আমাদের কাপ্তাই শহরে থাকতে হবে। অর্থাৎ নদীপথে বিলাইছড়ি পৌঁছে, সেখান থেকে কাপ্তাই লেকের মধ্য দিয়ে আরও দুই ঘণ্টার ট্রলার জার্নি করে কাপ্তাই শহর। রাত আটটার পরে কাপ্তাই লেকে ট্রলার চলাচল করা একরকম নিষিদ্ধ।

এদিকে ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা বাজে। যারা এসে পৌঁছায়নি, এতক্ষণ তাদের ওপর বিরক্তি লাগছিল। সময়জ্ঞান নিয়ে মনে মনে গালাগালিও দিয়েছে কেউ কেউ। এ দলটির মধ্যে আমাদের দলনেতাও ছিল। তাই বিরক্তি লাগাটা বেশি। সময়ের গুরুত্ব তার চেয়ে বেশি অন্য কারও থাকার কথা নয়। সেই বিরক্তিবোধ সরে গিয়ে এবার ভয় লাগতে শুরু করল; তারা কোনো বিপদে পড়েনি তো! মেঘলা আকাশ থাকায় এরই মধ্যে চারপাশ অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। ১১ জন মানুষের কোনো দেখা নেই। নেটওয়ার্ক না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগও করা যাচ্ছিল না। আবার ট্রেকিং করে গিয়েও খোঁজ নেওয়ার উপায় নেই। আমাদের সঙ্গে যে একজন গাইড এসেছিল, তাকে অনুরোধ করে আবার পাঠাই। যে একটি দোকান ছিল, সেটিও এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। ভয় ক্রমেই বাড়ছে।

ধূপপানি ঝরনার ভেতরের সৌন্দর্য।

সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আমাদের দলনেতা ভাই ফিরে আসে। তাকে কাঁধে করে নিয়ে আসে ধূপপানিপাড়ার কয়েকজন পাহাড়ি যুবক। সঙ্গে আমাদের আরও একজন সদস্য আসে। তখনো আরও ৯ জন এসে পৌঁছানো বাকি। ভাই যে অসুস্থ, তা এতক্ষণে সবাই বুঝে গেছে। কারও মুখে কোনো শব্দ নেই। তবে ভয় দূর হয়ে এবার সবাই যেন কিছুটা চিন্তামুক্ত হলো। সাড়ে ছয়টার দিকে বাকিরাও ফিরে আসে। চারপাশ অন্ধকার। আকাশের মেঘাচ্ছন্ন ভাব কিছুটা কেটে গিয়ে চাঁদ দেখা গেছে।

ঝরনা থেকে ফেরার মুহূর্তে সেখানেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় ভাইটি। তখন তারা ১১ জনই সেখানে ছিল। তারা ভেবেছিল হয়তো দুর্বলতার কারণে এমন হয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে, এই আশায় অপেক্ষা করছিল। কিন্তু কিছুতেই জ্ঞান ফিরছিল না। এদিকে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে। কোনো জনমানুষের পদচারণ নেই। গহিন অরণ্যে কেবল তারা ১১ জন। সঙ্গে একজন গাইডও ছিল। প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর গাইড বলল, আর বেশি দেরি করলে ফেরা যাবে না। পরামর্শ দিল, ধূপপানিপাড়া থেকে কয়েকজন যুবককে নিয়ে এলে তারা ভাইটিকে কাঁধে করে পৌঁছে দিতে পারবে। বিনিময়ে কিছু টাকা দিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সঙ্গীরাও রাজি হয়ে যায়। বিকল্প কোনো উপায়ও ছিল না। সেখান থেকে সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারলেই যেন বেঁচে যায়।

উলুছড়ি থেকে ট্রলার ছাড়তে ছাড়তে সন্ধ্যা সাতটা বেজে যায়। ওই দিন ঢাকায় ফেরাও বাতিল হলো। এখন কেবল একটাই চিন্তা, সুস্থভাবে ও নির্বিঘ্নে বিলাইছড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই হলো। ট্রলারের চালক পরামর্শ দিল সবাইকে ভেতরে চুপচাপ বসে থাকতে, কেউ যাতে কোনো সাড়াশব্দ না করে। এক ঘণ্টা পর প্রথম সেনাক্যাম্পটিতে পৌঁছাই। দেরি হওয়ার কারণ তাদের বলার পর খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ওপর মহলে কথা বলে আমাদের ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়।

বাকিটা পথ কেউ মোবাইলের আলো পর্যন্ত জ্বালেনি। ট্রলারের ভেতর সবাই নীরব। পাহাড় কিংবা নদীর পাড় থেকে কেউ দেখলেও কারও বোঝার ক্ষমতা নেই যে ট্রলারের ভেতর কোনো মানুষ আছে! রাত প্রায় ১০টা বেজে যায় বিলাইছড়ি পৌঁছাতে। সেখানে হোটেলে খাওয়াদাওয়া করে রাতে থাকার জন্য একটি কটেজের চারটি রুম ভাড়া করা হলো। পরদিন ভোরে ট্রলারে করে কাপ্তাই ফিরে আসি। সেখান থেকে বাসে করে ঢাকায়। দুজন চট্টগ্রাম থেকে বিমানে করে ফিরে আসি।