প্রস্থান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব সময় তিনটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবি—কী করছি? কেন করছি? পরিণাম কী হবে?

শ্রাবণের মধ্যদুপুর। গনগনে রোদের বন্যা চারপাশজুড়ে। ছেঁড়া কাগজের মতো কয়েক টুকরা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশের শরীরে। কয়েকটা চিল সেখানে ডানা ঝাপটাচ্ছে মাংসের টুকরা ভেবে। এসবের পাশ কাটিয়ে রৌদ্রভেজা পিচঢালা রাস্তা ধরে হেটে যাচ্ছি হেমলকের সন্ধানে। আমায় মরতে হবে।

কখনোই আবেগপ্রবণ ছিলাম না। তবে একেবারেই যে আবেগশূন্য, এমনটা নয়। আবেগহীন কোনো মানুষ এই দুনিয়ায় নেই। অনুভূতির যথার্থ প্রকাশে অপারগতা কিংবা আবেগের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে নিন্দুকেরা আমাকে ‘সিমার’ বলে ডাকে। আমার ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। সব সময় কবি ফররুখ আহমদের কবিতার দুটি লাইন মনে রাখার চেষ্টা করি—
‘হাসব মোরা সহজ মুখে
দুঃখ রবে লুকিয়ে বুকে
মোদের কাছে এলে সবার, জুড়িয়ে যাবে প্রাণ।’

এতক্ষণে হাঁটতে হাঁটতে রেললাইনের কাছে চলে এসেছি। এই তো এখন চোখ বুঝে ঝাঁপ দিলেই মৃত্যু কিংবা মুক্তি। জীবনকে বড্ড বেশি ভালোবাসি; যেভাবে মা তার সন্তানকে ভালোবাসে। প্রকৃতি আমার প্রশান্তির নীড়। তবু আজ জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাচ্ছি। কখনো ভাবিনি, এভাবে হারিয়ে যাব জীবনের বালিয়াড়িতে কোনো ছাপ না রেখেই। নির্জন দুপুরে মধুমতীর তীর কিংবা রাস্তার পাশে ওই যে চাওয়ালা, তার কি আমার কথা মনে পড়বে কখনো? বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় করমচার গা ছুঁয়ে যে এক ফোঁটা জল ঝরে যায়, কেবা তার খবর রাখে?

যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সব সময় তিনটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবি—কী করছি? কেন করছি? পরিণাম কী হবে?

কিন্তু আজ জীবনের এই বাঁকে এসে এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি যে প্রথম দুটি প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে পারিনি। ভাবতে চাইও না। আমি চলে গেলে কোথাও কোনো পরিবর্তন ঘটবে না জানি। যথানিয়মে ফজরের আজান হবে মসজিদের মাইকে। পাশের বাড়ির শিব্বির ভাই মাঠে যাবে কাস্তে হাতে। বাজারে দুধ বিক্রি করতে যাবে মনু মিয়া। কোথাও কিছু থেমে থাকবে না। শুধু বাবা একটু কাঁদবে। না, একটু না, বরং বড় আঘাত পাবেন তিনি। তাঁর একমাত্র আশার প্রদীপ যে আমি। শেষ বয়সের লাঠি। কিন্তু আমি তো অপারগ হয়ে পড়েছি। আমায় ক্ষমা করো বাবা।

ট্রেন আসতে এত দেরি করছে কেন? আমার যে বেঁচে থাকার যন্ত্রণা মৃত্যুযন্ত্রণার চেয়ে ভীষণ বেশি বোধ হচ্ছে। অদূরে ইলেকট্রিক তারে এক জোড়া কবুতর বসে আছে। কী মায়ার সংসার ওদের। আমার সংসারও কি এমন হতে পারত না? মায়ের মৃত্যুর মতো কঠিন দিন পাড়ি দিয়ে এসেছি। ভেঙে না পড়ে জীবনের বোঝা টেনে নিয়েছি ভাগ্যকে মেনে। এমন আরও কত বাস্তব তিক্ত সত্য, যা হওয়ারই। কিন্তু বেঁচে থাকার প্রধান দুই অবলম্বন—আশা ও বিশ্বাস তখনো টিকে ছিল। পরম যত্নে তা আঁকড়ে ধরে পথ চলেছি এত দিন। ক্লান্ত হলেও থেমে যাইনি। জীবনযুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবিনি ঘুণাক্ষরেও। কিন্তু আজ…।

ওই তো ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। আমার বিদায়ী সুর—কী করুণ, কী মধুর। ওহ, এত কথা হলো আপনাদের সঙ্গে, তাহলে বিশ্বাস ভঙ্গের গল্পটাও বলে যাই।

সেদিন এমনই নির্জন দুপুর। চমৎকার রোদ ছিল আকাশে। হঠাৎ এমন এক দৃশ্যের মুখোমুখি হলাম, যা সহ্য করার ক্ষমতা পাইনি বিধাতার কাছ থেকে। রাস্তা দিয়ে চলছিলাম আনমনে। একটা কবিতার লাইন মাথায় ঘুরছিল। বাসায় গিয়েই লিখে ফেলব ভাবছিলাম। রিকশার টিংটং আওয়াজে চোখ তুলতেই কবিতাকে ছুটি দিতে হলো। আমার বাল্যবন্ধু, আমার আজন্ম বিশ্বাস করা ছেলেটা বসে আছে সেই রিকশায়; আর তার পাশে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ রেখে বসে আছে আমার ভালোবাসার মানুষটা। আমার শ্যামলিমা।

বিশ্বাস ও ভালোবাসার এমন ব্যঙ্গাত্মক দৃশ্য সহ্য করতে পারিনি। বেঁচে থাকার দুই অবলম্বন এভাবে প্রতারণা করবে, ভাবিনি। তাই আজকে আমার ছুটি। ভালো থেকো মায়াভরা পৃথিবী। এই তো দুয়ারে এসে গেছে ওপারের পালকি। আমি চলে যাচ্ছি...।

লোহাগড়া, নড়াইল