বাংলাদেশের নিম্নবর্ণের হিন্দু নমশূদ্রদের জীবনযাপনের কাহিনি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্র ‘জীবনঢুলী’। তানভীর মোকাম্মেলের প্রতিটি প্রামাণ্যচিত্র, প্রতিটি চলচ্চিত্র নিরলস গবেষণার ফসল। সেভাবে কোনো একটিকে শ্রেষ্ঠ বলে বেছে নেওয়াটা হয়তো ঠিক নয়। কিন্তু ‘জীবনঢুলী’কে অন্যতম অবশ্যই বলা যেতে পারে।

জমিদারবাড়ির বউকে ধরে এনে বন্দী করে রাখা হয়েছে ক্যাম্পের একটি বেড়ার ঘরে। জীবন ঢুলীর চোখে যে মুখ, দুর্গা প্রতিমার মুখের মতো। জমিদারবাড়িতে পূজায় ঢোল বাজানোর সময় এই মুখের দীপ্তি তাকে উজ্জীবিত করত। আনন্দ দিত। অসহায় জীবন ঢুলী সারা জীবনের ঢোল বাজানো ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে এখন ড্রাম বাজায়।

ঢোলের মধ্যে হিন্দুয়ানি গন্ধ, বাঙালি বাঙালি গন্ধ। তাই পাকিস্তানি মুসলমানের ড্রাম। ইচ্ছা থাকলেও জীবন সেই মাতৃপ্রতিম, মাতৃপ্রতিমা মুখটিকে রক্ষা করতে পারে না। পাকিস্তানি বর্বর সেনা ঘরে ঢুকে তাকে ধর্ষণ করে। ঠিক সেই সময় ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসা মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ক্যাম্প ঘিরে ফেলে।

সেই আগমনবার্তা পেয়ে জীবন ড্রাম ছুড়ে ফেলে দিয়ে, আত্মহারা হয়ে বাড়ি থেকে নিজের ঢোল আনতে ছোটে। পাকিস্তানি সৈন্যরা বেড়ার ঘরটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। ধর্ষিতার বাঁচার আর্তনাদ কারও কানে গিয়ে পৌঁছায় না।

এভাবে দাউ দাউ করে ঘর জ্বলতে থাকার দৃশ্য, আমরা আন্দ্রেই তারকোভস্কির চলচ্চিত্রে দেখেছি। সামনে জলে ভেজা কর্দমাক্ত ভেজা মাঠ, পেছনে দাউ দাউ করে বাড়ি জ্বলছে অথবা ভোরের বনাঞ্চল প্রকৃতির বুকে জীবন্ত একটা ভোর জ্বলছে। প্রেক্ষাপট আলাদা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ, মানুষের সঙ্গে মানুষের লড়াই, যুদ্ধের অন্তিম পর্বে এসেও বহুমাত্রিক দহন।

বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম একটি দৃশ্যপট হয়ে উঠতে পারে ‘জীবনঢুলী’র এই অংশ। আনন্দে আত্মহারা জীবন ঢোল নিয়ে ছুটে আসে, দেখে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। ভেতরে কে আছে, সে জানে। কিন্তু বাঁচাতে পারে না। বাঁচাতে পারার মতো অবস্থা এখন আর নেই।

কী করবে! কী করা উচিত! বুঝতে না পেরে উন্মাদের মতো ঢোল বাজিয়ে যেতে থাকে। ঢোলেই তার মুক্তি। ঢোলেই তার বিসর্জন। দেশের দহন, মাটির দহন, মায়ের দহন এবং জীবনের আত্মদহন সব মিলেমিশে একাকার হয়ে এ এক অন্য বিজয়া। অশ্রুসিক্ত এ এক অন্য ভাসান।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের প্রথম ধাক্কা থেকে উচ্চবর্ণের ব্যানার্জি–চ্যাটার্জিরা দেশ ছাড়তে শুরু করেছিল। নিম্নবর্গের হিন্দুরা সেভাবে পেরে ওঠেনি। আবার এই নিম্নবর্গের মানুষের সামাজিক অবস্থানটা কেমন, বনেদি বাড়ির দুর্গাপূজা দেখলেই বোঝা যায়। সেখানে উচ্চবর্গের হিন্দুদের একজায়গায় খেতে দেওয়া হয়। মুসলিম এবং নিম্নবর্গের হিন্দুদের খাওয়ার ব্যবস্থা অন্য জায়গায়। এই ঢুলীপাড়ার মানুষের জীবন–জীবিকার সংকট আরও প্রবল। পূজায় বায়না পেতে শিয়ালদহে ছুটে আসতে হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ঢাক বাজানো শুনবেই বা কে? প্রাণে বেঁচে থাকতে হলে যখন জন্মভিটা ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

গ্রামে মিলিটারি ঢুকে পড়ে। নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়, এদিক–ওদিক, মাঠে, ঘাটে ছুটে কেউ বাঁচতে পারে, কেউ পারে না। লুটপাট, ধর্ষণ। বাড়ির জিনিসপত্র একেবারে না-মূল্যে কেজি দরে বিক্রি করে অথবা সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে ছোট ছোট ছেলে, মেয়ে, বৃদ্ধ, বৃদ্ধাদের নিয়ে সবাইকে দেশ ছাড়তে হয়। জীবন ঢুলী বউ, সন্তান আর কাকাকে নিয়ে রওনা দেয়। কাকিমা কিছুতেই ভিটেমাটি ছেড়ে যাবে না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের আর সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়া হয় না। অসংখ্য উদ্বাস্তুর সঙ্গে তার বউ, সন্তান আর কাকাকে হত্যা করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বড় গণহত্যা হয়েছিল সীমান্তবর্তী চুকনগরে। অসংখ্য উদ্বাস্তু এসে জড়ো হয়েছে দেশ ছাড়বে বলে। মিলিটারি সেখানে হানা দিয়ে দীর্ঘসময় ধরে নির্বিচার গুলি চালিয়ে সবাইকে হত্যা করে। সেই গণহত্যার দৃশ্য উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।

জীবন কোনোরকমে বেঁচে যায়। ফিরে আসে আবার গ্রামে। কাকিমা নিজে জাল ফেলে মাছ ধরছিল। জীবনকে ফিরে আসতে দেখে খুব খুশি। বাকিদের খবর শুনে পরক্ষণেই শোকে ডুকরে ওঠে। দেশমাতৃকার সঙ্গে তার পরনেও উঠে আসে শোককাতর বৈধব্যবেশ।
এভাবে সবকিছু হারিয়ে জীবন ক্রমেই একটা পাথরমানুষ হয়ে উঠতে থাকে। নিদারুণ শারীরিক অত্যাচারেও চোখে জল আসে না। মিলিটারি ক্যাম্পে বিনোদন জোগানোর জন্য ড্রাম বাজানোর কাজ পায়। চোখের সামনে দেখতে থাকে অমানবিক অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ। কখনো মনে প্রবল রাগ জাগে। শেষ পর্যন্ত অসহায় হয়ে থিতিয়ে পড়ে।
নারীর অবমাননা, দেশমাতৃকার অপমান ও বিজয়ার ভাসানের একটা রূপক তানভীর মোকাম্মেলের চলচ্চিত্রে বারবার উঠে আসে। মা এবং তার লাখো সন্তানের বিজয়ার ভাসানের শেষে, দীর্ঘ লড়াইয়ের বেদনাবিজড়িত বিজয়ও আসে। কিন্তু যা কিছু হারিয়ে গেছে, সেই শোক মানুষ ভুলবে কী করে!

‘জীবনঢুলী’ চলচ্চিত্রের দৃশ্যগ্রহণ, অভিনয়, গান, পাগলের ছড়া বলা—সবই বেশ ভালো। মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় রীতি অনবদ্য রূপ পেয়েছে। চুকনগর গণহত্যার সময় মরা মায়ের পাশে একটি শিশু কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল। অবিরাম গোলাগুলির মধ্যে সেই মেয়েকে সেখান থেকে তুলে নিয়ে যায় অন্য একজন। চলচ্চিত্রের দৃশ্যে সেই মেয়েও অভিনয় করেছে। বাস্তবের সঙ্গে চলচ্চিত্রের মিলনের এক সেতুবন্ধন। মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা আর  উদ্বাস্তুদের চোখের জল, দলিল হয়ে রইল এই চলচ্চিত্র।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত