‘একটু দেখো না, কোন জামাটা রাজর্ষিকে পরাব?’ স্টিলের আলমারি থেকে নতুন কয়েকটা জামা খুলে কানাইকে দেখাল শ্রীতমা। নিজের পরিহিত ধুতিটা ঠিক করতে করতে কানাই বলল, ‘আমার কোনো পছন্দ নেই। তুমি যেটা ঠিক মনে করো, সেটা পরাও, না হলে বাবাকে দেখিয়ে নিয়ো। আজকের বিশেষ দিনে পছন্দটা নাহয় বাবারই হোক।’
‘বাবাকে তো জিজ্ঞেস করবই, তবু তোমার একটা মত থাকতে পারে; সেটা জানতে চাচ্ছিলাম, মেয়েটা তোমার।’ উত্তরে কানাই বলল, ‘জীবনটাও তো আমার ছিল। বিবাহের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটাও কি আমি নিতে পেরেছিলাম? সারা জীবন এই ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।’ শ্রীতমা বলল, ‘এই প্রসঙ্গ এখন না উঠালেই কি নয়? বাড়িতে অনুষ্ঠান, বাড়িভর্তি লোক। আর চাইলেই তুমি এটা থেকে বের হতে পারো।’
‘কেন পারি না, সেটা তুমিও জানো–বোঝো আর আমিও। বিয়ে মানুষ জীবনে একবারই করে, বাবাও একবার করেছিল। বাবা সব মেনে নিয়েছিল। যাহোক, আমিও মেনে নেব।’
শ্রীতমা বলল, ‘কিন্তু সব সময় এই কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না কানাই। এ বাড়িতে আমার কোনো কিছুর অভাব নেই। তবু কোথাও মনে হয়, তুমি নেই। কাছে থেকেও নেই। এই কষ্ট বুকে নিয়ে দিন কাটাতে আর পারছি না।’
‘না পারলেও শিখে নাও। আমাদের বংশে মেয়ে নেই। তোমাকে আর আমাদের মেয়েকে সবাই আদর করে। তোমার কিংবা আমাদের সন্তানের এখানে কোনো অযত্ন হবে না। জীবনের সব হিসাব মেলে না, তবু মেনে নিয়ে মানিয়ে চলতে হয়। আমি মেনে নিয়েছি, তুমিও মানিয়ে নাও।’
বাবারা হয়তো এমনই হয়। দায়িত্ব–কর্তব্য ঠিক রাখতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছু ভুলে যায় কিংবা ভুলে থাকতে শিখে যায়।
উঠানে নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দে মুখর চারদিক। চারপাশে মানুষের আগমন শুরু হয়ে গেছে। উঠানের একপাশে বড় করে প্যান্ডেল করা হয়েছে। অনেক দিন পর সাহা বাড়িতে অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে।
দাদু শ্রীবাস নাতনিকে নিয়ে মন্দিরঘরের বারান্দায় বসে আছেন। উনি যে কতটা আনন্দিত, তা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বংশের নিয়ম অনুসারে অন্নপ্রাশন বাড়িতেই আয়োজন করা হয়।
কানাইয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক এসেছে। সে তাদের নিয়ে ব্যস্ত। এ ছাড়া শ খানেক আমন্ত্রিত অতিথি এসেছে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে বাড়িভর্তি লোক। দায়িত্ব–কর্তব্যের দিক দিয়ে কানাই কখনো পিছুপা হয় না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলেও কাউকে সে কখনো অবহেলা করেনি। কিন্তু বাড়িতে কোনো অনুষ্ঠান হলে, লোকসমাগম হলে তার সেই পুরোনো ক্ষত নতুন করে জেগে ওঠে। তবু কানাই নিজেকে সামলে নিতে পারে। নিজের ব্যবহারে কখনো প্রকাশ করতে দেয় না যে সে কষ্টে আছে।
রাজর্ষিকে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজানো হচ্ছে। সে বসে আছে তার দাদুর কোলে। চারপাশে আরও লোকজন। শ্রীতমা এদিক–সেদিক ঘুরে তার ভাই পল্লবকে প্রস্তুত করিয়ে বাড়ির মন্দিরে নিয়ে এসেছে। অন্নপ্রাশনের সময় হয়ে এল। আশপাশে তাকিয়ে কোথাও কানাইকে দেখতে পেল না।
‘এই যে আমার লক্ষ্মী বোন, ধরো ধরো, এটা ধরো, ওটা ধরো।’ দাদু শ্রীবাস বলতে লাগল। রুপার বাটিতে পায়েস দেওয়া হয়েছে আর সোনার চামচ দিয়ে সেই পায়েস রাজর্ষিকে কোলে নিয়ে খাওয়াল মামা পল্লব। রাজর্ষি কাঁসার থালায় রাখা বিভিন্ন জিনিসের মধ্যে কলম ধরল। এটা দেখে সবাই আনন্দিত হলো এই ভেবে যে মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো হবে। এভাবেই আনন্দের সঙ্গে অন্নপ্রাশন হয়ে গেল।
মন্দিরের সব কাজ শেষে মেয়ে রাজর্ষিকে নিয়ে শ্রীতমা দোতলায় নিজের ঘরে যাচ্ছিল, এমন সময় সিঁড়িতে কানাইকে দেখতে পেল। শ্রীতমা বলল, ‘মেয়েকে একটু কোলে নাও না, খুব কান্না করছে, যা গরম পড়েছে আজ। তুমি কোলে নিলেই কান্না থেমে যাবে।’
আহা! দেখছ তো আমি কাজে আছি, বিরক্ত কোরো না—মুখে না বললেও দুই হাতের ব্যাগ নিচে রেখে মেয়েকে কোলে নিল কানাই। বাবার কোলে উঠে মেয়ে সত্যিই চুপ হয়ে গেল। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব ক্লান্তি আর কষ্ট দূর হয়ে গেল কানাইয়ের। কিন্তু বেশিক্ষণ রাখতে পারল না সে। খাবার পরিবেশনে দেরি হয়ে যাচ্ছে, সেখানে যেতে হবে।
‘রাজর্ষির মা, ওকে নাও, ঘুমিয়ে পড়ছে, বিছানায় নিয়ে যাও। আমাকে প্যান্ডেলে যেতে হবে। দই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সেটা নিতেই ওপরে এসেছিলাম।’ মেয়েকে স্ত্রীর কোলে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল কানাই। শ্রীতমা তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। গরমে ঘেমে ভিজে গেছে শরীর। শত দায়িত্ব আর কাজও মানুষটাকে ক্লান্ত করতে পারে না। শ্রীতমাকে জীবনসঙ্গী করে মানুষটা মন থেকে খুশি না হয়েও দিব্যি সংসার করে যাচ্ছে। কারও প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। বাইরে থেকে দেখে কেউ বুঝবে না, কতটা কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে সে।
বাবারা হয়তো এমনই হয়। দায়িত্ব–কর্তব্য ঠিক রাখতে গিয়ে নিজের ব্যক্তিগত অনেক কিছু ভুলে যায় কিংবা ভুলে থাকতে শিখে যায়। এ রকম নানা চিন্তা করে হাঁটছিল শ্রীতমা। হঠাৎ একটা ডাকে পেছনে তাকাল সে। বাবা ডাকছে, ‘আমার চশমাটা ব্যাগের কোনদিকে যেন রেখেছিল তোর মা, খুঁজে পাচ্ছি না। একটু বের করে দে তো।’ ‘দিচ্ছি বাবা, তুমি সোফায় বসো।’
মেয়েকে বিছানায় রেখে বাবার চশমা খুঁজতে লাগল শ্রীতমা। চশমা খুঁজে দিয়ে নিচে বাবার জন্য খাবার আনতে গেল সে। কয়েক বছর হলো, বাবার দুই পায়ে বাতের সমস্যা। দিন দিন এটা বাড়ছে, বেশি হাঁটাচলা করতে পারে না।
রাজর্ষি ঘুমাচ্ছে। সাহা বাড়ির তৃতীয় প্রজন্মের প্রথম কন্যাসন্তান সে। প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মে কোনো কন্যাসন্তান নেই এ বংশে।
হাজীপুর, নরসিংদী