জাহাঙ্গীরনগরে অনেক স্মৃতি জমানোর একটি দিন

উৎসবে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করছেন লেখকছবি: বন্ধুসভা

আজানের ধ্বনি কানে আসামাত্রই বিছানা ছাড়ি। ফজরের নামাজ আদায় করে দেলোয়ার ভাইকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে জবাব আসে, ‘ভাই, আমি রেডি’। কেরানীগঞ্জের রামেরকান্দার উদ্দেশে একটি রিকশা নিয়ে চলে আসতে বলে আমার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে থাকি। দেলোয়ার ভাই আসবে সিরাজদিখানের বেগম বাজার থেকে, ততক্ষণে প্রস্তুত হতে সমস্যা হবে না। শুক্রবার ছুটির দিনে নতুন কোনো স্থানে ভ্রমণ ও জুমার নামাজ আদায় করতে আমরা প্রায়ই বের হই বিভিন্ন গন্তব্যে। এবারের গন্তব্য নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সকাল ছয়টা, রিকশা নিয়ে বাড়ির সামনে হাজির দেলোয়ার ভাই। হাতব্যাগে ছাতা, পানি, কলাসহ হালকা নাশতা নিয়ে উঠে পড়ি ত্রিচক্রযানে! আবদুল্লাহপুর থেকে রামেরকান্দা নেমে, আবার কলাতিয়ার উদ্দেশে রিকশা ভাড়া করে উঠে পড়ি। কলাতিয়া ব্রিজ পার হওয়ার আগেই রাস্তার পাশে দেখতে পাই ঐতিহ্যবাহী ক্ষুদেভাত ও ভর্তা-ডিম-মুরগির মাংসের সমন্বিত প্যাকেজ বিক্রি করছেন মধ্যবয়সী এক চাচা। কৌতূহলে দরদাম করতে করতে নেমে যাই রিকশা থেকে। প্যাকেজ মাত্র ৭০ টাকা। দুজনেই খেয়ে নিলাম পরম তৃপ্তিতে। ঝাল ভর্তা-ভাতে জিব ও পেটের যন্ত্রণা কমাতে কলাতিয়া বাজারের বিখ্যাত দধি ও জিলাপি সেঁটে দিই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে।

হেঁটে কলাতিয়া সেতু পার হতেই সিএনজির চালকের হাঁকডাকে সাড়া দিয়ে হেমায়েতপুর বাস কাউন্টারে। হেমায়েতপুর নেমে বাসে করে মাত্র ২৫ টাকা ভাড়ায় পৌঁছে যাই সবুজ পত্রপল্লব ও ফুল-পাখির অপার সৌন্দর্যে ঘেরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মূল ফটক পেরিয়েই হাতের বাঁ দিকে চায়ের দোকানে বসে ধূমায়িত লাল চা পান শেষে কিছু দূর সামনে এগোতেই চোখে পরে অমর একুশে ভাস্কর্য। শিল্পের অপরূপ সৌন্দর্যে বিস্মিত চোখে কিছুটা বিরক্তি আসে অমর একুশের মতো নন্দিত ভাস্কর্যের সামনে দিয়ে ঝুলে থাকা অসংখ্য বৈদ্যুতিক তার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য ভাস্কর্যপ্রেমীর চোখে এসব তার যেন এক মহা বিরক্তির নাম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি বিনীত নিবেদন, যেখানে-সেখানে ছড়ানো অপরিকল্পিত এ অযাচিত তারের কুণ্ডলী দ্রুতই অপসারণ করা হোক।

আরও কিছুটা সামনে এগোতেই শহীদ মিনার। জাবির এই শহীদ মিনার মূলত জাবিকে দিয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি। সবুজ লেনের ওপর আকাশচুম্বী উচ্চতায় সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ মিনারটি অপার সৌন্দর্যের এক ধারক।

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র, জহির রায়হান মিলনায়তনসহ বিভিন্ন অনুষদ ঘুরে কিছুটা ক্লান্ত হলে ২০০ টাকা ঘণ্টা চুক্তিতে আধা ঘণ্টায় ১০০ টাকার বিনিময়ে একটি রিকশা করে পুরো ক্যাম্পাসটি চোখের জালে আঁটকে নেওয়ার বৃথা চেষ্টা করে মনের ক্ষুধা বাড়িয়ে, তৃষিত হৃদয়ের উত্তাপ কমাতে বটতলায় গিয়ে কাঁচা আমের ফ্রেশ শরবত, লেবু-পুদিনার যুগলবন্দী অমৃত পানীয় পান করে গাছপাকা পেঁপে আস্বাদন করে আশপাশে প্রচুর স্থিরচিত্র ধারণ করি।

জুমার নামাজের আজান কানে ভেসে আসামাত্রই নামাজের আগেই ক্ষুধার্ত আত্মাকে তৃপ্ত করতে বটতলার বড় বড় খাবারের দোকানকে পাশ কাটিয়ে নিতান্তই সাধারণ, কিন্তু আদতেই অসাধারণ ঘরোয়া রান্নার ছোট রেস্তোরাঁ বাঙালি হোটেল থেকে মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিই। দুজনে মিলে প্লেটভর্তি আনলিমিটেড ভাতের সঙ্গে তিন পদের ভর্তা, করলা ভাজা, টমেটো সালাদ, কই মাছ, মুরগির চচ্চড়ি, পাতলা ডাল দিয়ে পেট পূর্তি করে বিল দিয়েছি মাত্র ২২০ টাকা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারেও শায়েস্তা খাঁ আমলের অনুভূতিতে কিছুটা হলেও অবগাহন করা যায়।

বিকেল চারটা, যে উদ্দেশ্যে নগরের ব্যস্ততা কাটিয়ে জাহাঙ্গীরনগরে আসা, সে উদ্দেশ্য পানে ছুটলাম। বন্ধুসভা জাতীয় পর্ষদের উদ্যোগ ও জাবি বন্ধুসভার সহযোগিতায় আয়োজিত ফল উৎসব ২০২৩-এর আয়োজন শুরু হয় নির্ধারিত সময়ে। অসাধারণ আয়োজনের প্রতিটি মুহূর্ত রাঙিয়ে তোলে জাবি বন্ধুসভা।

নান্দনিক মঞ্চ, সাজসজ্জার পাশাপাশি অনন্য উপস্থাপনা, নৃত্য, গান আর দেশি বাহারি ফলের প্রদর্শনী ও আপ্যায়নে অনুষ্ঠানটিকে করে তুলেছে অত্যন্ত সফল ও বর্ণাঢ্য। জাতীয় পর্ষদের সভাপতি, নির্বাহী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আলোচনা, বন্ধুসভার বন্ধুদের সাবলীল উপস্থাপনায় একটি সফল অনুষ্ঠানের সাক্ষী হয়ে মনের গহিনে অনন্য অসাধারণ স্মৃতির পসরা সাজিয়ে যে পথে গিয়েছিলাম প্রিয় জাবিতে, সেই পথেই ফিরে আসি গৃহকোণে। ততক্ষণে অনেক স্মৃতি জমিয়ে ফেলেছি মনের কোণে।

একটি যথার্থ অর্থবোধক ছুটির দিন মনকে রাঙিয়ে তোলার আবেশটুকু ছড়িয়ে দিলাম দিনলিপিতে। সবশেষে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটা লাইন লিখেই ইতি টানছি দীর্ঘ লেখার—
‘থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।’

সভাপতি, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা