ভেবেছিলাম লিখব না। বিদ্যুৎ নেই। ঘরের ভেতর ভ্যাপসা গরম, ঘরে থাকার উপায় নেই। বের হয়ে বাড়ির সামনে এসে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সুন্দর চাঁদ উঠেছে, ঝিঁঝি ডাকছে, পুকুর থেকে ভেসে আসছে ব্যাঙের চিৎকার। সবুজ ঘাসের ওপর জোছনা এসে লুটিয়ে পড়েছে, তার ওপর আবার কয়েকটা জোনাকও ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাতাস না থাকলেও ভ্যাপসা গরম নেই বাইরে। ভাবলাম, লিখেই ফেলি বসে বসে, এই সুন্দর চাঁদটা মাথার ওপরে নিয়ে।
লেখালেখির শুরুটা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে। স্কুলজীবনে প্রচুর গল্প, উপন্যাস পড়লেও কখনো কিছু লেখার কথা মাথায় আসেনি। তবে লেখকদের প্রতি বাড়তি দুর্বলতা ঠিকই ছিল। মনে মনে আফসোস করতাম ইশ্! যদি ওনার মতো হতে পারতাম, একেক সময় একেকজন হতে ইচ্ছা করত। তারপর একাডেমিক বইয়ের চাপে ধীরে ধীরে এসব ভূত দূর হয়ে গেল। ভার্সিটিতে পড়ার সময় টুকিটাকি লিখতে শুরু করি। গল্প, কবিতা, আর্টিকেল—এসব দিয়েই হাতেখড়ি। লেখার মান নিয়েও দ্বিধায় ভুগতাম খুব। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ধারণা নেই। দ্বিতীয়ত, যা লিখছি সেগুলো কি লেখা হচ্ছে নাকি কিছুই হচ্ছে না, এ নিয়ে ঝামেলা পোহাতাম। এখনো এই ব্যাপার নিয়ে ভুগি যে আমি যা লিখি, সেগুলো মনে হয় কিছুই হচ্ছে না।
আমার ট্রেন ছিল রাত এগারোটায়। স্টেশনে ঘণ্টা তিনেক আগেই এসে উপস্থিত হই দুর্গম এলাকার জন্য। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ ঘুমে টলোমলো। আমি স্টেশনে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। মোহনগঞ্জ স্টেশন, যেখানে রেললাইন এসে তার সমাপ্তি টেনেছে। অন্যদিকে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
বন্ধুসভার পাতায় অনেক দিন ধরেই লিখছি। সেদিন যখন লেখক বন্ধু উৎসবের খবরটা জানতে পারলাম, রেজিস্ট্রেশন করতেও খুব বেশি কালক্ষেপণ করিনি। চূড়ান্ত বাছাইয়ের অপেক্ষায় ছিলাম এবং খুদে বার্তায় আমন্ত্রণের খবর দেখে খুশি হয়ে যাই। লেখালেখি নিয়ে জানার প্রতি আমার এক সুপ্ত আগ্রহ অনেক আগে থেকেই। এই সুযোগটা কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইনি। ফুফাতো বোনের বিয়ের অর্ধেক অনুষ্ঠান ফেলে ঢাকার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি শুধু কর্মশালায় উপস্থিত থাকার লোভে।
আমার ট্রেন ছিল রাত এগারোটায়। স্টেশনে ঘণ্টা তিনেক আগেই এসে উপস্থিত হই দুর্গম এলাকার জন্য। প্রচণ্ড ক্লান্তিতে চোখ ঘুমে টলোমলো। আমি স্টেশনে বসে ঝিমুচ্ছিলাম। মোহনগঞ্জ স্টেশন, যেখানে রেললাইন এসে তার সমাপ্তি টেনেছে। অন্যদিকে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। ঝিমুতে ঝিমুতে আমি যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা মনে নেই। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার কারণে ঘেমেঘুমে সজাগ হয়েছি ট্রেন ছাড়ার ঠিক আধঘণ্টা আগে। চারদিকে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, গুটিকয় মুঠোফোনের আলো জ্বলছে, সুনসান নীরবতা চারদিকে। প্রথমে একটু ভয় পেয়েছিলাম যে সবকিছু নিয়ে গেল কি না ঘুমের মধ্যে। ভাগ্য ভালো ছিল। ব্যাগ, মুঠোফোন সবকিছু ঠিকঠাকই রয়েছে। তারপর একটু এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে ট্রেনে উঠে বসলাম। সকালে ট্রেন থেকে নেমে কমলাপুর স্টেশনে হাতমুখ ধুয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে পা বাড়ালাম।
আমরা নির্বাচিত ৪৪ জনসহ কর্মশালায় আমন্ত্রিত বক্তাদের কথাগুলো শুনছিলাম মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। ভাষার সঙ্গে কবির লড়াই কী করে কবিতা হয়ে ওঠে, দেখার ভিন্নতা কবিতাকে কী করে রূপ দেয়, ছন্দের কারসাজি, কবিতার অভিধান ইত্যাদি পানি খেতে খেতে সহজ করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন সাজ্জাদ শরিফ। যদিও কবিতা আমার কাছে বরাবরই দুর্বোধ্য লাগে।
অভিজ্ঞতা, কল্পনার গাঁথুনিতে কীভাবে শব্দেরা গল্প হয়ে ওঠে, ধীরে ধীরে সেগুলো বিশ্লেষণ করেন শাহনাজ মুন্নী। ওনার সঙ্গে আবার নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও যুক্ত করেন আনিসুল হক ও মোহিত কামাল। বলেছেন নিজেদের কথা, লেখার কথা, পড়ার কথা। প্রশ্নোত্তর পর্বে সবাই সুযোগ করে দেন বন্ধুদের যত জিজ্ঞাসা, লেখালেখি নিয়ে জমা রাখা প্রশ্নের কথা। দুপুরের ক্লান্তি দূরে ঠেলে ফিচারের খুঁটিনাটি বিষয়ে আলোচনা করে শ্রোতাদের মনোযোগ কেড়ে নেন আলতাফ শাহনেওয়াজ। ‘কে, কি, কখন, কোথায়’ উপস্থিত রেখে গল্প বলার কৌশলই যে ফিচার, তা সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে সাংবাদিক ফিরোজ চৌধুরী শুনিয়েছেন কীভাবে ব্যর্থ হতে হতে সাংবাদিক হয়ে বসে আছেন। শুনিয়েছেন ভুল সময়ে, ভুল বাসে হারিয়ে যাওয়া ‘এনু রাখাইনের’ কথা।
আমি কাছ থেকে দেখেছি সেরা ১০–এ জায়গা পাওয়া মানুষগুলোর চোখেমুখে প্রস্ফুটিত উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাসের দৃশ্য একের পর এক বন্দী হচ্ছিল ক্যামেরায়। আমিও সেরা ১০–এর একজন ছিলাম। পুরস্কার হাতে নিতে নিতে নিজেকে আবারও প্রশ্ন করি, আমি কি তবে ভালো লিখি?
সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বন্ধুসভা