‘স্বপ্ন টানে দিলাম পাড়ি
অচিন পথে আপন ছাড়ি।
পেছন ফেলে উঠান বাড়ি,
প্রিয় মুখ আর স্মৃতির শাড়ি,
মন বলে চল ফিরে আবার
স্বপ্ন যাবে বাড়ি আমার।’
ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার ঠিক আগে আগে মনের ভেতর এ গানটি বাজতে শুরু করে। মধুর এক টান অনুভব হয়। যে যেখানেই থাকি না কেন, সবাই ছুটে চলি আপনজনের কাছে। মনের মধ্যে অনুভূত হয় চরম এক আকুতির। সবার একসঙ্গে হওয়ার আকুলতা। পারিবারিক মিলনমেলায় একত্র হই।
ঈদ মানেই খুশি। ঈদ মানেই আনন্দ। এই আনন্দ করতেই পরিবারের কাছে ছুটে যাই। আবার এই আনন্দ ভ্রমণই কারও কারও জন্য গভীর শোক বা দুঃখ বয়ে নিয়ে আসে।
শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে যাঁরা এখনো বেকার, যাঁদের বিয়ে হয়নি, যাঁদের ডিভোর্স হয়ে গেছে, যাঁরা পরীক্ষায় ভালো করতে পারেনি , যাঁরা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো কোনো জায়গায় ভর্তি হতে পারেনি; কিংবা যাঁরা একাকী জীবন কাটান শহরে নিজের মতো করে। তাঁদেরও একধরনের আতঙ্কের মধ্য দিয়ে ঈদের ছুটি শুরু হয়। একটা চাপ মাথায় নিয়ে পরিবারের কাছে যেতে হয়। আতঙ্কের মধ্যে থাকে, কখন যে কে কোন বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসে!
বেকারদের শুনতে হয়, এখনো একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে না! কত শখ করে পড়িয়েছিলাম শহরে রেখে। কবে ভালো একটা চাকরি পাবা?
রেজাল্ট এত খারাপ হয় কেন তোমার? সিজিপিএ কেন ভালো ওঠে না? জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পাবে তো? পড়াশোনায় মনোযোগ দাও না, রেজাল্ট তো খারাপ হবেই!
সারা দিন মোবাইলে পড়ে থাকো না? মোবাইলে আছে কী? মানুষের সন্তান পারে, তুমি কেন পারো না? নাহ্, তোমার দ্বারা কিছু হবে বলে আশা করা যায় না। কী পড়াশোনা করছ, এত দিন শহরে থেকে থেকে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং বা ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলে না! তোমাদের কি না খাইয়ে রাখি?
বেকারদের শুনতে হয়, এখনো একটা চাকরি জোগাড় করতে পারলে না! কত শখ করে পড়িয়েছিলাম শহরে রেখে। কবে ভালো একটা চাকরি পাবা? বয়স তো চলে যাচ্ছে। তখন তো আর বিসিএস দিতে পারবে না।
যদি পরিবারের পছন্দের বাইরে কোনো পেশায় চাকরি হয়; তাহলে শুনতে হবে, এটা কোনো চাকরি হলো! অমুকের ছেলেমেয়েরা ভালো ভালো চাকরি করে। আর আমাদের লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায়। এত কম টাকায় চলা যায়?
যদি ছেলে বা মেয়ে বিয়ের উপযোগী হয়ে থাকে, তাহলেও কথা শুনতে হয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে কবে বিয়ে করবা? বিয়ের তো বয়স চলে যাচ্ছে, চেহারা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিয়ের বয়স চলে গেলে বাচ্চা নিতে পারবা না। তখন কি কেউ তোমাকে কেউ বিয়ে করবে? ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না।
ছেলেদের শুনতে হয়—এখনো যে বিয়ে করো না, কবে নতির মুখ দেখব? পছন্দ থাকলে তো হতো, তাহলে এত ঝামেলা হতো না!
আবার বিবাহিত হলে শুনতে হবে, কবে বাচ্চা নিচ্ছ? এখনো বাচ্চা নিচ্ছ না কেন? কোনো সমস্যা আছে কি? থাকলে ডাক্তার দেখাও। শুধু ক্যারিয়ার নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? আমরাও তো সংসার করছি। মেয়ে সন্তান যদি থাকে; তখন বলবে, একটা ছেলে সন্তান তো খুবই জরুরি। নইলে বংশের বাতি কে দেবে! বাপ-দাদার বাড়িতে কোনো বাতি জ্বলবে না!
আর যাঁদের ডিভোর্স হয়েছে কিংবা একা থাকছেন; সেখানে তো কথাই নেই! আর সেটা যদি একজন মেয়ে হয়ে থাকে; তাহলে তাঁর আর রক্ষা নেই! কী করলা? সংসারটা টিকিয়ে রাখতে পারলা না। মেয়ে মানুষের ধৈর্য ধরা উচিত! তোমার জন্য তো আমরা সমাজে মুখ দেখাতে পারি না। এখন তোমাকে কে বিয়ে করবে? বাড়ি গেলে এমন নানা কটু কথা শুনতে হয়।
আপনার হয়তো কোনো চাহিদা নেই; তবু আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা আপনাকে অসংলগ্ন চাহিদা পূরণ করার প্রস্তাব দিয়ে বসবে। আপনি যদি রাজি না হন, তাহলে শোনাবে—একা থেকে থেকে বেশি স্বাধীন হয়ে গেছে মেয়ে। শহরে যা মন চায় তা–ই করে বেড়ায়। কোনো কথা বলতে দ্বিধাবোধ করবে না।
যাঁদের ভালোবাসার টানে আমরা ছুটে যাই নাড়ির টানে, একসঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ করে থাকি, শুধু দুটি দিন ভালো সময় কাটানোর আশায়। কারও কারও জীবনে সেটা আর হয়ে ওঠে না। এমন অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। মনে হয়, আমাকে কেউ ভালোবাসে না। ভীষণ একা অনুভব হয়। আমাদের মধ্যে তখন দুশ্চিন্তা, রাগ, কষ্ট, আতঙ্ক, লজ্জা, কলঙ্কিত, অবহেলিত, হতাশা কাজ করে। নিজেকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা বেড়ে যায়। কারও সামনে যেতে ইচ্ছা করে না, কথা বলতে ইচ্ছা করে না। সবাইকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। এই আচরণগুলোর কারণে আমরা পরিবার-প্রিয়জন থেকে দূরে সরে যেতে থাকি।
এমন অবস্থায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে এগিয়ে আসতে হবে। যে সদস্যটি কটু কথা শুনছে, তাঁকে বলতে হবে, আমরা তোমার পাশে আছি। কে কী বলল কিছু যায় আসে না। পরিবার হিসেবে আমাদের যেসব কাজ করতে হবে—
* ওই মানুষটিকে সমানুভূতি দিয়ে দেখব।
* ওনার অবস্থানটা বোঝার চেষ্টা করব।
* এমন কোনো কথা বলব না বা আচরণ করব না, যেটাতে তিনি কষ্ট পেতে পারেন।
* পরিবারে সুন্দরভাবে গ্রহণ করা।
* মনে রাখতে হবে, ছুটির দিনগুলো আনন্দের সঙ্গে কাটাতে এসেছি। আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো স্মরণ করা যাবে না।
* যাঁদের সঙ্গে গল্প করতে বা আড্ডা দিতে ভালো লাগবে, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানো।
* অনেক দিন পর যেহেতু একত্র হচ্ছি, টাকাপয়সা, অভাব-অনটন নিয়েও আলোচনা হতে পারে। খেয়াল রাখা—সেটি যেন আলোচনাই হয়, ঝগড়ার পর্যায়ে না যায়।
* কারও সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, কেউ আমাকে মনে কষ্ট দিয়েছিল; এমন কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সামান্য হাই-হ্যালো করতে পারি। নিজেকে চাপ দিয়ে নয়। মাথায় রাখব, আমরা এই কদিন আনন্দ করতে এসেছি।
সাইকোথেরাপিস্ট ও কনসালট্যান্ট, সিটি হাসপাতাল লিমিটেড