কেউ কেউ কবি হলেও কবিতা পড়তে কিন্তু সবারই ভালো লাগে; অন্তত ছোটবেলায় একটা বয়স পর্যন্ত। তখন নতুন বই কেনা হলে প্রথমে কবিতাগুলোই পড়া হতো। তারপর একা একা বা ক্লাসে একসঙ্গে মুখস্থ করে বলার মজাই ছিল আলাদা, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা/ মামার বাড়ি যাই’, ‘ওই দেখা যায় তালগাছ/ ওই আমাদের গাঁ’, ‘আমি হব সকালবেলার পাখি’, ‘ভোর হলো দোর খোলো’, ‘আমাদের ছোট নদী’—ছোটবেলায় যারা পড়েছে, তারা কি সারা জীবনে তা আর ভুলতে পারে!
খেলার ছড়াগুলোও, ‘ওপেনটি বায়োস্কোপ’, ‘ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি’ বা শিশুভোলানো ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ কি ‘খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল’। এ ছাড়া এক লাইন, দুই লাইন কি মনে পড়ে না, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ বা ‘পাখি সব করে রব/ রাতি পোহাইল’ খুব ভালো না লাগলে কি বড় বয়সেও হাইফাই করপোরেট চাকুরেদেরও তা মনে থাকে? সেই আমাদের বড় হতে গিয়ে কোথায় যে উবে যায় ওসব পিচ্চিবেলার ভালো লাগাগুলো! অল্প কজনের, যাঁরা একটু কবি–কবি, শিল্পসাহিত্য ভালো লাগে, তাঁদের কেউ কেউ কবিতাও পড়েন, লেখেন কেউ কেউ, আবৃত্তি করেন।
তবে বড় হয়ে আবৃত্তি করা নিয়ে বাধে গোল। স্কুল-কলেজের প্রতিযোগিতায় যারা নাম দেয়, খোঁজ নিতে হয় তাদের, আবৃত্তি প্রশিক্ষক কি আবৃত্তিশিল্পীটিল্পীদের। তাঁরাও তখন লেগে পড়েন শেখাতে। যাকে বলে শিক্ষা, যেকোনো শিক্ষার মতোই তাঁরা শিক্ষা দিয়ে ছাড়েন—কাকে বলে আবৃত্তিশিল্প: প্রমিত উচ্চারণ, ছন্দ, ভাব-রস, প্রয়োগ-প্রকাশভঙ্গি আরও কত কী! যাকে বলে মাথা ঘুরিয়ে ছাড়েন। ছোটবেলার সহজ ভালো লাগার তখন ‘ছাইড়া দে মা কাইন্দা মরি’ অবস্থা।
নিজের স্বভাব-মন-বয়স অনুযায়ী ভালো লাগার মতো কবিতাই আবৃত্তি করব। যে কথা বলতে পারি, বলার যোগ্য আমি, বিখ্যাত শিল্পীরা আবৃত্তি করেন বলেই নয়, তেমন কবিতা আবৃত্তি করব।
কঠিন এই শিক্ষাচর্চা কি নিজে নিজের মন-বুদ্ধিমতো সহজ করে নেওয়া যায় না? ছোটবেলার সেই সহজ ভালো লাগা থেকেই, মনে করে করে শুরু করা যায় না? নিজে নিজে মনে করে দেখি না, একেবারে ছোটবেলা থেকে যা কিছু পড়েছি, তার কী কী, কোনটা কোনটা মনে পড়ে! সেগুলো মনে করে বলে বলে দেখি তো কেমন লাগে! ছোটবেলার ভালো লাগাটা মনে পড়ে কি না। তখন যেমন স্বরে, সুরে, ছন্দে পড়ে বা বলে যেতাম, একবার তেমন করে বলে দেখি তো! তখন হয়তো ছোটবেলার মতো সুর করে গড়গড়িয়ে পড়াটা তেমন ভালো লাগবে না। বড় হয়ে গেছি না, ছোটদের মতো কি আর এ বয়সে পড়া যায়!
এমন তো মনে হতেই পারে। তাহলে কী করা যায়? ভেবে দেখি তো, বলে দেখি তো কবিতাগুলোর এখনো কোনটা কোনটা ভালো লাগে। ‘থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে/ দেখব এবার জগৎটাকে’, ‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও’, ‘সফদার ডাক্তার, মাথাভরা টাক তার’, ‘মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে’—কোনটা এই বড় বয়সেও বলা যায়; ছোটবেলার মতো করে নয়, এখনকার মতো কীভাবে বলতে পারি? কথার মতো বলতে গিয়ে একটা তাল কি পাওয়া যায়, একেক কবিতার একেক ছন্দ-লয়? অর্থ–ভাবমতো যেমন ইচ্ছা করে বলতে, তেমন তেমন মেজাজে, ধরনে তা বলা, আবৃত্তি–আবৃত্তি ভাব না করেও বলার একেক মজা তাতে লাগে কি না। এমনিতে যে কথা যেমন করে বলি, তেমনি সহজ বলার মতো করে অর্থ-ভাব বুঝে বুঝে বলা। শব্দের ঠিক উচ্চারণ বড়দের কারও কাছে জেনে নিয়ে, কীভাবে কোনটা বলি বা বলতে ইচ্ছা করে, সেভাবেই বলা। ভেবে দেখি তো, কোনটা কোনটা বললে অন্যেরও তা ভালো লাগবে। অর্থাৎ নিজের যেটা ভালো লাগে, সেটা কীভাবে বললে আর সবারও ভালো লাগবে, বুঝে নিয়ে বলা। তার মানে, কোন কবিতাটা আমার ভালো লাগছে, যা অন্যেরও ভালো লাগবে, সেটা বুঝেই বেছে নেব কবিতা। নতুন নতুন আরও সব কবিতা: রবীন্দ্র-নজরুল-জসীমউদ্দীন-সুকুমার রায়-সত্যেন দত্ত কি জীবনানন্দ-শামসুর রাহমান-আল মাহমুদ–সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা নিজে নিজে পড়ে বেছে নেব, কোনটা ভালো লাগছে পড়তে, বলতেও লাগবে ভালো। নিজের আবেগ যাতে জাগে। তবে তা যেন অন্যেরও ভালো লাগে, এটা বুঝে বেছে নেওয়া চাই কবিতা। নিজের স্বভাব-মন-বয়স অনুযায়ী ভালো লাগার মতো কবিতাই আবৃত্তি করব। যে কথা বলতে পারি, বলার যোগ্য আমি, বিখ্যাত শিল্পীরা আবৃত্তি করেন বলেই নয়, তেমন কবিতা আবৃত্তি করব। সব কবিতা কি চাইলেই কেউ এখনই আবৃত্তি করতে পারে, তার জন্য তৈরি হওয়া, যোগ্য হতে হবে, এই বুঝ থাকা চাই। অন্যে কে কেমন করেন আবৃত্তি, শুনব তা, তবে আর কারও মতো করেই বলব না, বলব নিজের মতো করে। যেমন করে আমার ভালো লাগে, বলতে আর শোনাতে ইচ্ছা করে, তেমন করব আবৃত্তি। বড়দের কাছ থেকে জেনে নেব উচ্চারণ ও কবিতার অর্থ-ভাব-ছন্দ। কিন্তু কারও মতো তোতাপাখির শেখানো বুলি অনুকরণ করব না।
ছোটবেলার স্বতঃস্ফূর্ত সুরে-ছন্দে সবার মতো এক রকম টানা বলে যাব না। আমি যেমন কথা বলি নিজের মতো করে, আর কারও মতো নয়, কবিতাও বলব, আবৃত্তি করব সেই একেবারে নিজের সহজ-স্বাভাবিক সত্যমতো করে। কথাটা যেন মনে রাখি। এমন কবিতা করব না, যা আমার তেমন লাগছে না, ভালো বা বুঝছি না, তেমন কবিতা অনেকে করেন বলেই করব না। তার মানে, আমার ভালো লাগা, আমার বলতে ইচ্ছা করা দিয়ে ঠিক করব, কোনটা ভালো করে তৈরি করে বলব, আবৃত্তি করব। তেমন কবিতা বারবার, নানাভাবে বলে বলে ঠিক করব, কীভাবে বললে মনে হচ্ছে যে বলতে ভালো লাগছে, তাহলেই অন্যেরও তা ভালো লাগবে। কেবল প্রতিযোগিতা বা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্যই পড়ব না, বলব না। নিজের যা ভালো লাগে, যা অন্যদের শোনাতে ইচ্ছা করবে, সেটাই ভালো করে তৈরি করে অন্যদের শোনাব। এই নিজের ইচ্ছা আর ভালো লাগা দিয়ে যদি পড়ি, বলি আর বুঝে দেখি অন্যের কেমন লাগবে, এই দুটো বুঝে নিয়ে আবৃত্তি করব। আবৃত্তির জন্য প্রচলিত কবিতাই কেবল বলব না, খুঁজে খুঁজে, অনেকের কবিতা পড়ে নিয়ে বেছে নেব আমার ভালো লাগার কবিতা, যা অনেকের ভালো লাগবে বলে মনে করব, নতুন নতুন তেমন কবিতা তৈরি করব, বলব আর আবৃত্তি করব। যা শুনে যেন মনে হয় যে আমার কথাই বলছি যেন সত্যি সত্যি। এই নিজের কথার মতো বলতে পারলেই বলা বা আবৃত্তি সত্য হবে। তোতাপাখির মতো কারও শেখানো বুলি হবে না তা, মনে হবে না অমুক আপা বা ভাইয়ের মতো হচ্ছে। তবে শুনব অন্যের, অনেকের আবৃত্তি, তার কোনো–কোনোটা ভালোও লাগবে নিশ্চয়ই। তাঁদের থেকে শিখব, বুঝব, জানব; কী করে কোনটা আমি কেমন করে বলব। অর্থাৎ আমার মতো করে বলাটা শেখার জন্য, আরও ভালো করে বলার জন্য শুনব শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিকারদের কবিতা যেমন শম্ভু মিত্র, কাজী সব্যসাচী, প্রদীপ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, রত্না মিত্র বা গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী আরিফ, কামরুল হাসান মঞ্জু, গোলাম সারোয়ার, শিমুল মুস্তাফা, লায়লা হাসান, শারমীন লাকি—সবারটা শুনে শিখে নেব আমার মতো করে আবৃত্তি করার ধরন-পদ্ধতি-রীতি।
কবিতা বলায়, আবৃত্তিতে যেন নিজেকে প্রকাশ করতে পারি, যা আর কারও মতো নয়, একেবারে নিজের মতো, তাহলেই কবিতা পড়ে, বলে, আবৃত্তি করে এমন কিছু পাব, যাকে বলে অমৃত, যা কারও মতো করে বলায় লভ্য নয়।
তার জন্য গানের মতোই ‘মিলিত হবে দুইজনে/ একজন গাবে খুলিয়া গলা/ আরেকজন মনে’।
লেখাটি ২০১৫ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের ‘তারুণ্য’ ম্যাগাজিনের পঞ্চম সংখ্যা থেকে নেওয়া।
আবৃত্তি ও নাট্যকলার শিক্ষক