সম্পর্কের দূরত্ব এবং দুই পৃথিবীর ‘দূরত্ব’

শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘দূরত্ব’ছবি: সংগৃহীত

মোরশেদুল ইসলামের ‘দূরত্ব’ একটি আন্তর্জাতিক মানের শিশুতোষ চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রটি অমর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। আমাদের আজকের শহুরে নাগরিক জীবনে কর্মরত ব্যস্ত মা–বাবার ঘরবন্দী একলা শিশুর নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন, খাঁচার পাখির মতো দানাপানি খেয়ে খাঁচার ভেতরে বেড়ে ওঠার চরম পীড়াদায়ক যাপনের কথা, ব্যথা, এই চলচ্চিত্রে বড় আকারে উঠে এসেছে।

পুতুলের বাবা আনিসুর রহমান সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি। ধনী ব্যবসায়ী। মা জেসমিনও ভীষণ ব্যস্ত, কর্মজীবী। দুজনই সকালে বেরিয়ে রাতে বাড়ি ফেরে। ঢাকার গুলশানে তাদের মস্ত বড় সুসজ্জিত বাড়ি। বাড়িতে বাগান আছে। বাড়ির সব কাজকর্ম দেখাশোনার জন্য অনেক লোকজন আছে। পুতুলের সর্বক্ষণের দেখাশোনা করে একজন বুয়া। বই পড়ে, ছবি এঁকে, ভিডিও গেম খেলে, টিভিতে কার্টুন দেখে পুতুলের সময় কাটে। কিন্তু অন্তর্মুখী ভাবুক প্রকৃতির কিশোরটির এই বন্দিজীবন ভালো লাগে না। মনের নিঃসঙ্গতা কাটে না। বুয়া সারাক্ষণই তাকে আদর যত্নে রাখে, সময়মতো ভালো ভালো খাবার বানিয়ে দেয়। কিছুই তার খেতে ভালো লাগে না। ইচ্ছে হয় মা–বাবার সঙ্গে বসে খাবে, মায়ের মুখে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে; কিন্তু তা হয়ে ওঠে না।

বাড়ির বড় গাছটা কেটে ফেলা হবে শুনে তার দুঃখ হয়। গাছের গায়ে গিয়ে হাত বোলায়। রাস্তায় কিছু একটা হইচই হচ্ছে শুনে জানালা খুলে দেখে, সাপুড়ে সাপের খেলা দেখাচ্ছে। সে বুয়াকে জিজ্ঞাসা করে, সাপ লোকটাকে কামড়ায় না? বুয়া বলে, সাপটাকে সে পালন করেছে তো, তাই কামড়ায় না। এভাবে প্রতিনিয়ত জগৎ–প্রকৃতি, বাইরের পৃথিবী তাকে ঘর ছেড়ে বাইরের পানে টানে।

আরেক দিন বাড়ির গেট খোলা পেয়ে সে বেরিয়ে যায়। একজন লোক মাথায় ঝুড়িতে কিছু নিয়ে যাচ্ছিল। পুতুল তার পিছু নেয়। তাকে জিজ্ঞাসা করে, আপনার ঝুড়িতে কি সাপ আছে? সে বেশ চমকে যান! ঝুড়িতে সাপ থাকবে কেন! ঝুড়ি নামিয়ে দেখায়, সে পাটালি গুড় বিক্রি করে। পুতুলকে এক টুকরা পাটালি গুড় খেতে দেয়। খেতে বেশ ভালো লাগে।

ঘুরতে ঘুরতে পুতুল একটা পার্কে এসে বসে। সেখানে অন্তু মিয়া নামে সমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে দেখা হয়। অন্তু তার কুকুরটার ওপরে নানাভাবে অত্যাচার করছিল। পুতুল জানতে চায়, কেন সে এমনটা করছে? অন্তু বলে, তার ইচ্ছা হয়েছে, তাই করছে। পুতুলকে শুনিয়ে শুনিয়ে সে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলে। পুতুল কোনো দিন এ ধরনের ভাষা শুনতে অভ্যস্ত নয়। তবে ধীরে ধীরে অন্তুর সঙ্গে পুতুলের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এখান থেকেই দুই পৃথিবীর মিলনের শুরু। এক পৃথিবী ছিল উচ্চবিত্ত ধনী পরিবারের, অন্য পৃথিবী চরম দারিদ্র্যের, কষ্টের এবং শৈশব থেকেই হাতে–পায়ে লড়াই করে বেঁচে থাকার।

অন্তু কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে থাকে। সেখানে ভিক্ষা করে, খায়দায় ঘুমায়। তার একটা বোন আছে। বোনের নাম মরিয়ম। মরিয়ম স্টেশনে যাত্রীদের কাছে পানীয় জলের বোতল বিক্রি করে। অন্তু আর মরিয়মের বাবা থাকে ময়মনসিংহ স্টেশনে। সেখানে বস্তিতে ওদের ছোট্ট একটা ঘর আছে।

পুতুল যে এত বড় একটা বাড়ির ছেলে, অন্তু আর মরিয়ম কখনো ভাবতে পারেনি। বাড়ি দেখে দুজনই অবাক। পুতুলের কাছে মরিয়ম জানতে চায়, তোমরা কি দেশের রাজা? পুতুল বলে, আসবে আমাদের বাড়ি? দুজনেই মাথা নেড়ে জানায়, না। ছেঁড়া সেই সোয়েটার খুলে দিয়ে দেয় পুতুল।

পুতুল অন্তুর সঙ্গে ঠেলাগাড়ির পেছনে চেপে বসে। পুকুরে গিয়ে মাছ ধরে। পরনের লাল গেঞ্জিটা ডুবে যেতে দেখলে, সেটা উদ্ধার করতে আবার পানিতে নেমে পড়ে, আর নিজে ডুবে যেতে থাকে। ঘাটে কাপড় কাচছিল এক মহিলা। তিনি পানিতে নেমে পুতুলকে তুলে আনে। একটা চড় মারে। এভাবে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, অনেক অজানা মানুষ আর অচেনা পরিবেশের মধ্যে পুতুলের সময় দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে।

মরিয়ম নামের ছোট্ট মেয়েটা পুতুলের কথা শুনে শুনে শুধু হাসে। ফুটপাতের হোটেলে অন্তু, মরিয়ম আর পুতুল খাবার খায়। ময়মনসিংহ যাবে বলে তিনজনে ট্রেনে চেপে বসে। ট্রেনে পুতুল এক আজব মানুষের সন্ধান পায়। তিনি ছোট্ট মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে ম্যাজিক দেখান, দাঁতের মাজন বিক্রি করেন, গান করে শোনান, কান পাকা মলম ‘কর্ণসুন্দর’ বিক্রি করেন, মুখে শব্দ করে দুই বেড়ালের লড়াই দেখান। আরও অনেক কিছুই জানেন, কিন্তু তার কাছ থেকে কেউ কিছু কেনে না। মরিয়ম পুতুলকে বলে, একেকজন একেক কিসিমের লোক। এই ব্যক্তি যদি শুধু গান করে ভিক্ষা করত, তাহলেও অনেক টাকা পেত। কিন্তু ভিক্ষা করে না। আবার বিক্রিবাটাও তার ভাগ্যে লেখা নেই। পুতুল মরিয়মের কাছ থেকে একটা টাকা নিয়ে কর্ণসুন্দর কেনে। এক টাকাতে ওই ব্যক্তি আরও একটা মলম ফ্রিতে দেয়। সেই টাকা দিয়ে বাদাম কিনে খায়।

এদিকে পুতুলের বাবা-মা ছেলেকে খুঁজে না পেয়ে অস্থির। প্রভাবশালী বাবার নির্দেশে পুলিশ কমিশনার, প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চারদিকে খোঁজ চলে। তবে পুলিশ যে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তেমন কোনো দৃশ্য কিন্তু চলচ্চিত্রে আসেনি। পুতুল তো ঢাকার রাস্তায়, স্টেশনে, ট্রেনে অনেক জায়গায় ছিল। কমিশনারকে একজন শুধু ফোন করে জানায়, একজনের খোঁজ মিলেছে। সে কথা বলতে পারছে না।

আবার সমাজের প্রভাবশালী এত বড় একটি পরিবারও বিপদের সময় একজন পীরের সাহায্য নেয়। যে পীর নাকি কাপড়ের গন্ধ শুকে নিখোঁজের সন্ধান দিতে পারে। অথচ বাস্তবে দেখা গেল, পীর যা বলছে, হারিয়ে যাওয়া পুতুলের বর্তমান অবস্থানের সঙ্গে কিছুই মিলছে না। সেই পীরের কথা শুনে বিভ্রান্ত, পুতুলের বাবা সেই সব জায়গায় খোঁজ নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিচ্ছে। পুতুলের সন্ধানে মাইক প্রচার করা হলে, উড়ো ফোন আসে। কিছু দুষ্কৃতি ফোন করে দাবী করে, তারা পুতুলকে কিডন্যাপ করেছে। পুতুলের বাবা যেন কাউকে কিছু না জানিয়ে, চুপচাপ কুড়ি লক্ষ টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসে।

পুতুলের মা কেঁদেকেটে অস্থির। পুতুলের বাবাও যেকোনো ভাবে ছেলেকে খুঁজে পেতে মরিয়া। এতদিন ধরে দুজনেই যে ছেলেকে ঠিকমতো সময় দিয়ে উঠতে পারেনি, তা ভেবে তারা আজ মনে মনে অনুতাপে দগ্ধ।

অন্তু আর মরিয়ম পুতুলকে নিজেদের বস্তির বাড়িতে নিয়ে যায়। ওদের বাবার খুব জ্বর। বাবা শুয়ে আছে। মরিয়ম উনুনে তিন মিশেলি রান্না করে। তিনজনে মিলে খায়। এই সম্পূর্ণ অপরিচিত পৃথিবীটা পুতুলের ভালো লেগে যায়। তবে অনেক কিছুই মেনে নিতে পারে না। যেমন অন্তুদের বস্তি ঘরে নোংরা জায়গায় পুতুলের বসতে ইচ্ছা হয় না। মরিয়ম একটা ছেঁড়া সোয়েটার পুতুলকে পরতে দেয়। নোংরা বলে পুতুলের পরতে ইচ্ছা হয় না। পরে অবশ্য শীতকাতর উপায়হীন হয়ে পরে নেয়, আর বুঝতে পারে, গরিবের ছেলেমেয়েরা সোয়েটার ছাড়াও থাকতে পারে।

সেই নোংরা সোয়েটার পরিহিত অবস্থায় অন্তু আর মরিয়মের সঙ্গে পুতুল অবশ্য নিজের বাড়িতে ফিরে আসে। পুতুল যে এত বড় একটা বাড়ির ছেলে, অন্তু আর মরিয়ম কখনো ভাবতে পারেনি। বাড়ি দেখে দুজনই অবাক। পুতুলের কাছে মরিয়ম জানতে চায়, তোমরা কি দেশের রাজা? পুতুল বলে, আসবে আমাদের বাড়ি? দুজনেই মাথা নেড়ে জানায়, না। ছেঁড়া সেই সোয়েটার খুলে দিয়ে দেয় পুতুল। হারানো ছেলেকে খুঁজে পেয়ে আত্মহারা মা–বাবা, বুকে জড়িয়ে চুমু খেতে থাকে। ভিন্ন পৃথিবীর হারানো দুটি শৈশব অন্তু আর মরিয়ম পায়ে পায়ে ফিরে যায়। রাস্তায় একজন কাগজ পোড়াচ্ছিল। সেখানে বসে তাপ নেয়।

এই চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপের সঙ্গে দৃশ্যবুনন অসাধারণ। শিল্প নৈপুণ্যের দিক থেকে একটি আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র। ছোট–বড় সবার দেখার মতো। পুতুল, অন্তু, মরিয়ম তিন চরিত্রে তিন শিশুশিল্পী ফাহাদ, অমল আর মিথিলা অসাধারণ অভিনয় করেছে। পুতুলের বাবা হুমায়ূন ফরীদি আর মা সুবর্ণা মুস্তাফা দুজনেই অনন্য। সম্প্রতি সুবর্ণা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বর্তমানে ফেসবুক, ইউটিউবে যে ফলোয়ার বা জনপ্রিয়তা বাংলাদেশের কিংবদন্তি শিল্পীরা এভাবে কেউ উঠে আসেননি। নিজের কাজের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নিজেকে প্রমাণ করে ইতিহাস হয়েছেন। এক বর্ণও মিথ্যে বলেননি সুবর্ণা।

অন্যান্য চরিত্রে রাইসুল ইসলাম আসাদ, হাকিম ফেরদৌস, আখতার হোসেন, দেলোয়ার হোসেন, ওয়াহিদা মল্লিক, শহীদুল আলম সাচ্চু, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রহমত আলী, তানিয়া—প্রত্যেকেই সুন্দর অভিনয় করেছেন। ইমন পালের সুর নৈঃশব্দ্যের বুকে নৈসর্গের পরিপূর্ণতাকে সুন্দর ধরতে পেরেছে। শীতের সকালে পুতুলকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে অন্তু আর মরিয়ম সঙ্গে অন্তুর কুকুরটিও আছে। আবার পুতুল চলে যাওয়ার পর দুজনে ফিরে যাচ্ছে, এ ধরনের টুকরো টুকরো দৃশ্য বিদেশি চলচ্চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। এল অপু রোজারিওর চিত্রগ্রহণ, রতন পালের সম্পাদনা ভালো।

বাঙালি জনপ্রিয় এবং মনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের বর্তমান এবং চিরকালীন সমস্যাজর্জরিত নিখাদ একটি কাহিনিকে বিশ্ব বাঙালির হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পেরেছেন শক্তিমান পরিচালক। ‘দূরত্ব’ যদি সামাজিক এবং আর্থসামাজিক বৈষম্য–দূরত্ব ঘোচাতে পারে, যান্ত্রিক মানুষকে পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনের নৈকট্য এনে দিতে পারে, তবেই ধরা দেয় এ ধরনের চলচ্চিত্রের প্রকৃত সাফল্য।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত