অটোগ্রাফ

অটোগ্রাফঅলংকরণ: হামিদ ভূঁইয়া

নতুন কবি হিসেবে বইমেলায় যাই। প্রতিদিন যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলেও যাই। প্রকাশকের জোরাজুরিতে যেতে হয়। আজকাল নাকি সবকিছু বিজ্ঞাপনের ব্যাপার। নিজেকেই সেই বিজ্ঞাপন দিতে হয়। মুখে কবি কবি ভাব করে বসে থাকতে হয়! তা ছাড়া মানুষজন বই না কিনুক, অন্তত কবির মুখ দর্শন তো করুক। এই সৌভাগ্য থেকে তাঁদের বঞ্চিত করাও ঠিক হবে না।

আমার বই খুব একটা বিক্রি হয় না। অটোগ্রাফও কেউ চাইতে আসেনি। তারপরও আমি দামি একটা কলম কিনেছি। ভক্তদের তো আর যেনতেন কলম দিয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া যায় না! বিকেল হলেই আমি স্টলের পেছনের দিকে বেজার মুখ করে বসে থাকি। বিক্রেতা স্মার্ট কয়েকজন তরুণ-তরুণী। ওরা আড়চোখে আমার দিকে তাকায়। নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কথা বলে। হয়তো আমার মতো লেখকদের নিয়ে দুই–চারটা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে। সে করতেই পারে। বইয়ের বিক্রি নেই অথচ কবি প্রতিদিন হাজিরা দেয়। উৎসাহ নিয়ে খোঁজ নিই আজ কোনো বিক্রি আছে কি না। প্রায় দিনই একই উত্তর। হতাশাজনক। ওরা অবশ্য আশা দেওয়ার জন্য বলে, স্যার এখন বই কেউ তেমন পড়ে না। মোবাইলের যুগ তো!

এই যখন অবস্থা, তখন একদিন বিকেলে স্টলে বসে চা খাচ্ছি। তখনো পরিচিত কারও সঙ্গে আড্ডা জমেনি। এমন সময় একটা ছোট্ট মেয়ে এল। হাতে ডায়েরি।
‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’ আমি অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে তাকাই। আট-নয় বছর হবে। চুল পেছন থেকে বেণি করে বাঁধা। কথার সঙ্গে সঙ্গে সেই বেণি দুলছে।
‘তুমি অটোগ্রাফ নেবে?’
‘জি।’
‘তুমি আমার বই পড়েছ? এটা তো কবিতার বই। বড়দের।’
‘আমি পড়িনি, মা পড়েছে। আপনার সব কবিতাই মা পড়ে।’ আমি বেশ অবাক হলাম। আমার এমন একজন পাঠিকা আছে এটা তো অজানাই থেকে যেত, যদি না প্রকাশকের জোরাজুরিতে প্রতিদিন মেলায় এসে বসে না থাকতাম।
‘তোমার মা আমার সব কবিতা পড়েন?’
‘জি।’
‘তাহলে অটোগ্রাফ নিতে তোমার মা এল না যে?’ এবার মেয়েটি অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। আমার মায়া হলো। আমি চটপট ডায়েরিটা খুলে একটা কিছু লিখে দিই।

মেয়েটি সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। আমার কৌতূহল জাগে। কৌতূহল মানুষের বৈশিষ্ট্যজাত। আমিও তার বাইরে নই। অযাচিতভাবে মেয়েটির পিছু নিই। উদ্দেশ্য আমার কবিতার একনিষ্ঠ পাঠিকাকে একবার দর্শন করা। সে না চাইলেও তাঁকে আমার দেখতে হবে। তা ছাড়া কবি উপস্থিত থাকতেও যিনি কবির সঙ্গে কথা না বলে তাঁর ছোট্ট মেয়েকে পাঠান অটোগ্রাফ নিতে, সেই রহস্যময়ী পাঠিকাকে একবার হলেও দেখা দরকার।

আমার স্টলের পেছন দিকে পাশ ফিরে এক মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। সামনে থেকে আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। সেই আলোতে স্পষ্ট তাঁকে চিনতে পারলাম। সময় যতই গড়িয়ে যাক, আমার তাঁকে চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। শুধু শরীরে মেদ জমেছে। ভারী হয়েছে শরীর। ডায়েরি হাতে নিয়েই লক্ষ্য করেছিলাম ওপরে মেয়েটির নাম লেখা ছিল মেঘলা। বহু বছর আগে আমরা দুজন ঠিক করেছিলাম আমাদের মেয়ে হলে তার নাম রাখব ‘মেঘলা’।

পাবনা