টানা ভারি বর্ষণ ভোররাতেও বন্ধ হয়নি। নাহিয়ান টিনের চালের ঝমঝম শব্দ আর ব্যাকুল মনে ভাবতে ভাবতে একটুর জন্যও চোখের পলক ফেলেনি। বাইরের ঝড় আর ভেতরে তুফান নিয়ে ভোরের আলো-আঁধারিতে সে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে। কলসির মুখে ঢেলে দেওয়া বৃষ্টি উপেক্ষা করে পুকুরপাড়ের গন্ধরাজগাছের ডাল বেঁকিয়ে ফুল নিল বেশ কয়েকটা। বাতাস, বৃষ্টি আর বিজলির আঁকাবাঁকা রেখা আকাশের বুক চিরে ক্ষণিক আলো ছড়িয়ে আবার মিইয়ে যায়। গ্রামের পথঘাট কেমন যেন অচেনা মনে হয় নাহিয়ানের। দীর্ঘদিন ঘরের মুখ দেখেনি সে। শহরের অজানা এক ভবনের চিলেকোঠায় শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে রাখত সর্বক্ষণ। ঝঞ্ঝাট ছেড়ে ছুটে আসতে চেয়েছে বহুবার, কিন্তু পারেনি।
বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নাহিয়ান বাড়ির পাশের নদীর পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করে মৃদুভাবে। বৃষ্টির ছাটে চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে মুখজুড়ে। উন্মত্ত বৃষ্টিতে শরীরে অনাবৃত অংশে চিনচিনে অনুভব হচ্ছে। হৃদয় ব্যথিত হয় একচিলতে নদীটার দিকে তাকিয়ে। মনে পড়ে, এ নদীর পাড়ে বসে একদিন শ্রাবণীকে লখিন্দর-বেহুলার গল্প শুনিয়েছিল। শ্রাবণীও বেহুলা হওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল সেদিন। নাহিয়ান ভাবল, বেহুলাবিহীন লখিন্দরের জীবনে আর কীই–বা থাকে।
বৃষ্টির জল মাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল গ্রামের শেষ প্রান্তরের প্রাচীন কবরস্থানটার দিকে। ঢুকতেই দেখতে পেল একটা শান বাঁধানো শুভ্র নির্মল কবর। শম্বুকগতিতে এগিয়ে গিয়ে পা মুষড়ে বসে পড়ে নাহিয়ান। মুহূর্তেই যেন তার সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে; মৃদুভাবে হাত বোলায় চারুময় কবরের দেহে। সমাধিলিপিতে অন্তিমযাত্রার সময়টা লেখা আছে স্পষ্টভাবে। নাহিয়ান আঙুলে গুনে দেখল খুচরা মাসসহ প্রায় দুই বছর। হৃদয়ের মাতমে সে লুটে পড়ে। লম্বালম্বি হয়ে কবরটি জড়িয়ে ধরে গগনবিদারী চিৎকার দেয়। অস্ফুটের মতো হৃদয়ের জমিতে বরফ গলে পড়ে অশ্রুরূপে।
অশ্রু আর বৃষ্টির জল মিশে একাকার হয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে মিশে যাচ্ছে পাশের নদীটায়। নদীর মতো যদি হৃদয়ে বহমানতা থাকত, অথই জলে হরেক দুঃখের বিকিকিনি হতো। ভাটার টানে জমে থাকা পাড়ের আবর্জনার মতো ধুয়েমুছে নিয়ে যেত। সকালে লোকের আনাগোনা বাড়তে থাকলে নাহিয়ান সংবিৎ ফিরে পেয়ে চকিতের মতো উঠে দাঁড়ায়। পাহাড়সম বিষণ্নতা নিয়ে নাহিয়ান নদীর পাড় ধরে হাঁটা শুরু করে অন্তহীন অজানার উদ্দেশে।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা