১৯৬৮ সালে নির্মিত প্রখ্যাত পরিচালক নারায়ণ ঘোষ মিতার চলচ্চিত্র ‘এতটুকু আশা’। চলচ্চিত্রে পরিবারের ভাঙা-গড়ার ছবি, সমাজের ধনী–গরিবের ব্যবধান, শহুরে উচ্চবর্গের মানুষের জীবনাচারণ, ভিন্ন ধারার সংস্কৃতির সঙ্গে মধ্যবিত্ত সমাজের চিরাচরিত সংস্কৃতির সংঘাত—সবকিছুই সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ছোটবেলায় চট্টগ্রাম শহরে ছুটির দিনগুলোতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা করে চলচ্চিত্র দেখতাম। এই চলচ্চিত্রটি আগে কখনো দেখেছি কিনা, এখন আর মনে করতে পারছি না। তবে এই চলচ্চিত্রে মো. মনিরুজ্জামানের লেখা, সত্য সাহার সুর করা এবং আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়...’ গানটি এমন কোনো বাংলাদেশের মানুষ নেই, যে কখনো শোনেনি।
আমিও বহুবার টেলিভিশনে চিত্রায়িত এই গান দেখেছি। আমার কবিতার মধ্যেও লিখেছি, আমার মা যে দু-তিনটি গান ঘুরেফিরে গুনগুন করতেন, তার মধ্যে এটি একটি। এই গানের অন্তর্নিহিত বেদনা চোখে জল এনে দেয়। বাংলাদেশের হাজারে হাজারে মানুষ দুঃখভরা চিত্তে এই গান গুনগুন করে। চলচ্চিত্রে অভিনেতা আলতাফের অসাধারণ অভিনয়ে গানের মহিমা, গানের তাৎপর্য অসামান্য রূপে ফুটে উঠেছে। আলতাফ কিন্তু সে অর্থে এই চলচ্চিত্রের নায়ক নন। নায়ক বা নায়িকার কণ্ঠে সব সময় চলচ্চিত্রের সেরা গানটি ব্যবহার করতে হবে, তাহলেই তা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে; তেমন ধারণাও ভেঙে দেয় এই চলচ্চিত্র। প্রমাণ করে দেয়, পার্শ্ব চরিত্রের কণ্ঠে ব্যবহার করা হলেও গানের এবং অভিনয়ের গুণে তা কোটি কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলতে পারে। কালজয়ী হয়ে উঠতে পারে।
শিল্পীদের কাজই হলো অগোচরে থেকে যাওয়া অন্ধকার জীবনের খবরগুলোতে আলো ফেলে শিল্পায়িত করে জনসমক্ষে তুলে আনা। ‘এতটুকু আশা’ নিরাশ করেনি।
আলতাফ এখানে একজন পার্শ্বচরিত্র। কাহিনি অনুযায়ী গরিব কৃষক পরিবারের প্রতিবন্ধী সন্তান। যাবতীয় সম্বল সর্বস্ব ক্ষয় হতে হতে পথে এসে বসা এই ভঙ্গুর পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে শহরের রাস্তায় খবরের কাগজ বিক্রি করছে সালাম মানে আলতাফ। এই গানের দৃশ্যে তাঁর সঙ্গে তরুণ বয়সের অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামানকেও দেখা যায়। সালামের বৃদ্ধ কৃষক বাবা দেনার দায়ে আজ জর্জরিত, অধিক জরাগ্রস্ত। তবু বড় ছেলেকে যেভাবে তিনি পড়াশোনা করিয়ে মানুষ করে তুলেছেন, কন্যাকে সেভাবে পড়াশোনা করাতে চান। সংসারের হাল ধরতে বৃদ্ধ বয়সে শহরের রাস্তায় একজন ফেরিওয়ালা হন। গানের মধ্যে সেই দৃশ্যও উঠে আসে।
গরিব বাবার সুশিক্ষিত বড় ছেলে আলমের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। বড় চাকরি পাওয়ার পরে শিক্ষকের অনুরোধে সে শিক্ষকের কন্যা লুসিকে বিয়ে করে। লুসি ও তার মা হলো শিক্ষকের ঘরে একেবারে উল্টোধারার, শহুরে হোটেল-নাইট ক্লাব-পার্টি ইত্যাদি অভিজাত সংস্কৃতির বশ হওয়া প্রতিনিধি। লুসিকে বিয়ে করে আলম বাধ্য হয়ে গ্রামের কৃষক বাবার পরিবার থেকে শহরে উঠে আসে। এই দুই সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব প্রতিনিয়ত তাকেও খুঁড়ে খুঁড়ে আহত করে।
লুসির বড় ভাই কবিরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রাজ্জাক। কবির একজন চিত্রশিল্পী, জীবনযাপনে বাউন্ডুলে। মা আর বোনের সংস্কৃতি তাকে ছুঁতে পারে না। চিন্তা চেতনায় সে মুক্তধারার, কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল নয়। উচ্ছৃঙ্খল সংস্কৃতির ইতরদের সে ভালো চোখে দেখে না। আলম আর সালামের বোন হেনার প্রেমে পড়ে সে। হেনার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুজাতা। মন মানুষী হেনার যে ছবি আঁকে কবির, সেই অপরূপ ছবির মতোই সুন্দর তাদের প্রণয়ের দৃশ্য বুনন। দুঃখ, দারিদ্র, কষ্ট, গ্রামের সুদখোর মোড়ল জোয়ারদারের অত্যাচার, অভিসন্ধি—এগুলো যেমন এই ছবির একটা দিক, আবার মানব মানবীর প্রণয়, স্নেহ ভালোবাসার বন্ধন, চিরাচরিত প্রেম চলচ্চিত্রকে আশাহত জীবন থেকে ভালোবাসার বিশ্বাসের স্তরে রূপান্তরিত করে। বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়।
জোয়ারদারের সাগরেদ এবং হাভাগোভা ছেলের অভিনয় হাস্যরসের খোরাক জোগায়। শহুরে ক্লাব সংস্কৃতির ভোগবাদী অসভ্যতার মুখোশও একসময় লুসির সামনে খোলসা হয়। সে বুঝতে পারে এই স্বাধীন জীবনে তার নারীত্বের মুক্তি নেই। বরং এই আসক্তির জীবন যেভাবে পারিবারিক সম্পর্কের ভিত পর্যন্ত নড়িয়ে দিতে পারে, সেটাও একটা বড় শিকল। নিজের ভেতরে এই দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে হারিয়ে সে পুনরায় আলমের সংসারে ফিরে আসে। জোয়ারদারের হাভা ছেলের সঙ্গে ননদের বিয়ে বন্ধ করে দেয়। নিজের গয়না দিয়ে জোয়ারদারের ঋণ মেটায়। শহুরে শিল্পী কবিরের সঙ্গে গ্রামের কন্যা হেনার মিলন হয়। সব ধরনর সামাজিক, আর্থসামাজিক ভেদাভেদ ঘুচে যায়। মিতা যে কত বড় মাপের একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন, তা প্রমাণিত হয়।
এই ছবিতে রাজ্জাক, সুজাতা, আনোয়ার হোসেন, রোজী, আলতাফ ছাড়াও অভিনয় করেছেন রহিমা, হাসমাত, ওয়াহিদা, খোকন, সুলতানা, সরওয়ার, রূপা, সাইফুদ্দিন, আ. সোবহান, গীতা রাণী দে, মো. শফিক, বিলকিস বারী, একে কোরাইশী, সুরাইয়া, অধীর বাবু, হালিমা, বিনয় বিশ্বাস এবং আরও অনেকে। যন্ত্র সংগীত সামলেছেন আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রা। গীতিকার মো. মনিরুজ্জামান। সংগীত পরিচালনায় সত্য সাহা। সুন্দর সব গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন শাহনাজ বেগম, সাবিনা ইয়াসমিন, খোন্দকার ফারুক আহমেদ, আব্দুল আলিম, আব্দুল জব্বার ও আ. হাদী।
‘তুমি কি দেখেছ কভু..’ গানটিতে গীতিকার লিখেছেন ‘প্রতিদিন কত খবর আসে যে কাগজের পাতা ভরে/ জীবন পাতার অনেক খবর রয়ে যায় অগোচরে…’। শিল্পীদের কাজই হলো অগোচরে থেকে যাওয়া অন্ধকার জীবনের খবরগুলোতে আলো ফেলে শিল্পায়িত করে জনসমক্ষে তুলে আনা। ‘এতটুকু আশা’ নিরাশ করেনি। মানুষের সামনে মানুষের জীবনকে উৎসর্গ করে হাসি-কান্নার আনন্দ-বেদনার মহাকালের তরীতে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত