মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত দলিল ‘ওরা ১১ জন’

চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবির একটি দৃশ্য
চলচ্চিত্রটি বারবার মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য এই তরুণেরা কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতা যেমন এখানে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনই রয়েছে একটি জাতির জেগে ওঠার গল্প।

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্তির পর জাতির জীবনে যখন স্বপ্ন আর আশার আলো উঁকি দিচ্ছিল, তখন এই বিজয়গাথাকে সংরক্ষণ এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। সেই চিন্তা থেকেই চলচ্চিত্র নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম উদ্যোগ নেন একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণের। এটি ছিল তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এ বছর এটি মুক্তির ৫২তম বছরে পদার্পণ করেছে।

অর্থনৈতিক সংকট, যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা এবং সীমিত সম্পদ নিয়েও চাষী নজরুল ইসলাম ও তাঁর টিম এই ঐতিহাসিক সিনেমা নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থন ও প্রযোজক হিসেবে অবদান এই ছবিকে সফলভাবে বড় পর্দায় আনার পথ সুগম করে।

‘ওরা ১১ জন’ ছবির কাহিনি গড়ে উঠেছে ১১ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে কেন্দ্র করে। ভিন্ন পটভূমি থেকে আসা এই মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন, স্বপ্ন আর স্বজনদের ত্যাগ করে একত্রিত হন একটি মহান লক্ষ্যে—স্বাধীনতা অর্জন। তাদের প্রতিরোধ, যুদ্ধের কৌশল, এবং শত্রুদের মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

চলচ্চিত্রটি বারবার মনে করিয়ে দেয়, স্বাধীনতার জন্য এই তরুণেরা কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নির্মমতা যেমন এখানে তুলে ধরা হয়েছে, তেমনই রয়েছে একটি জাতির জেগে ওঠার গল্প। স্বাধীনতার জন্য যে আত্মত্যাগ ও সাহসিকতার প্রয়োজন হয়েছিল, তারই এক অমর চিত্রায়ণ ‘ওরা ১১ জন’।

চাষী নজরুল ইসলামের এই চলচ্চিত্রটি শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল।

চলচ্চিত্রের শুরুতেই একজন মুক্তিযোদ্ধার কণ্ঠে শোনা যায়, ‘এই যে খসরু ভাই, শুনেছেন, ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে অ্যাসেম্বলি বসবে না।’ এ খবর শোনার পরেই প্রতিবাদে রাজপথে শুরু হয় আন্দোলন। স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জনতার মিছিল। সবার মুখে মুখে একই স্লোগান—
‘জয় বাংলা। তোমার নেতা, আমার নেতা—শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’

মিতা চরিত্রটি একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত। মিতা একজন মেডিকেল ছাত্রী; যার মামাকে ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে। এই ঘটনা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। পরবর্তীতে মিতা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা করতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে। তার এই ত্যাগ ও দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীদের অবদানের প্রতীক হয়ে ওঠে।

নিজের বড় ছেলেকে হারিয়ে ছোট ছেলেকেও মুক্তিবাহিনীর হাতে সঁপে দেওয়া মায়ের চরিত্রে রওশন জামিল যেন অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর অভিনয়ে ফুটে ওঠে মাতৃত্বের গভীর ত্যাগ ও সাহসের অমর চিত্র। তাঁর চোখের ভাষা, শরীরী ভঙ্গি এবং সংলাপ বলার শক্তি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তবতাকেই যেন জীবন্ত করে তোলে।

এই দৃশ্য দেখে ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ সিনেমার সেই মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। যিনি ঘরের মধ্যে থাকা মুক্তিবাহিনীদের বাঁচাতে নিজের বাক্‌ ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী ছেলে রইসকে মুক্তিযোদ্ধা বলে পাকবাহিনীর হাতে তুলে দেন। এমন সিদ্ধান্তে মায়ের যে অসীম সাহস এবং ত্যাগের প্রকাশ ঘটেছে, তা ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আমরা ২৪-এর আন্দোলনেও এরকম মা-বাবাদের দেখেছি, যাঁরা নিজ সন্তানদের রাজপথে পাঠিয়েছেন।

দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, নায়ক রাজ্জাক অভিনীত পারভেজ চরিত্রটির কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের খবর বের করার জন্য ভয়ানক অত্যাচার করে। চোখের সামনে তার মাকে এবং ছোট ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এতটুকুতেই বর্বরতা শেষ হয়নি; বোন শীলাকেও নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তবু পারভেজ দেশের প্রতি ভালোবাসার শক্তিতে অটল থাকে। সে মুখ খুলে কোনো তথ্য দেয় না। এই চুপ থাকা ছিল যেন শত্রুর প্রতি এক কঠিন প্রতিবাদ। তার এই ধৈর্য আমাদের শিক্ষা দেয়, কীভাবে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক নিজের সর্বস্ব ত্যাগ করেও দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে পারেন।

চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গ্রামবাংলার চিত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসিকতা এবং শত্রুর মুখোমুখি হওয়ার দৃশ্যগুলো প্রাণবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। যুদ্ধের বিভীষিকার পাশাপাশি জাতির নবজাগরণের গল্পও এতে স্থান পেয়েছে।

চাষী নজরুল ইসলামের এই চলচ্চিত্রটি শুধু একটি সিনেমা নয়, এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের এক জীবন্ত দলিল। ‘ওরা ১১ জন’ নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবেই বিবেচিত হবে আজীবন।

বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা