শেষবারের মতো দেখা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শুনে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না, থমকে গেলাম কিছুক্ষণের জন্য। মানুষটার বাড়ি দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলায়। আজই গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছেন। পৌঁছানোর পর জানতে পারেন বাবার মৃত্যুর কথা। সৃষ্টিকর্তা গরিব মানুষকে সহ্যক্ষমতা একটু বেশিই দিয়ে থাকেন। এ জন্যই হয়তো তিনি এমন অবস্থায়ও দিব্যি রিকশা চালিয়ে যাচ্ছেন। যখন খবরটি আমাদের দেন, তাকিয়ে দেখি ওনার চোখে অশ্রু জমে আছে। কিছুক্ষণ পরপর গামছা দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছেন।

মাঝেমধ্যেই আসাদগেট থেকে রিকশা নিয়ে বাসায় ফিরি। ভাড়া ৫০ টাকা। কিন্তু সেদিনের চিত্রটা ছিল ভিন্ন। আমি ও আর্যা, দুজনই অনেক ক্লান্ত। এক রিকশাওয়ালাকে বললাম, সলিমুল্লাহ রোড যাবেন? উনি রাজি হলেন। ভাড়া জিজ্ঞেস করায় বললেন, ৩০ টাকা দিয়েন। শুনে বেশ অবাক হলাম। এত কম ভাড়া আগে কেউ চায়নি। উঠে বসলাম। পথিমধ্যে একজন বৃদ্ধ রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটছিলেন। ফুটপাত দিয়ে চলার কথা বললে উনি উল্টো আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, জ্ঞান না দিতে। এ নিয়ে রিকশাওয়ালা ভাইটির সঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি জানালেন, আজ ওনার বাবা মারা গেছেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। এমন কিছু শোনার পর চুপ করে থাকাটাই মনে হয় মানুষের চিরায়ত অভ্যাস। সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কথা খুঁজে বের করতেও যে সময় লাগে। জিজ্ঞেস করলাম, বাবাকে দেখতে আপনি যাবেন না? জবাবে বললেন, ‘হাতে টাকা নেই। একজন ১০০ টাকা দিয়েছে। বাড়ি যাওয়ার জন্য এতে হবে না, আরও লাগবে।’ অর্থের ব্যবস্থা করার জন্যই এখনো রিকশা চালাচ্ছেন। শুনে বেশ খারাপ লাগল। বললাম, এমন হলে তো বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে পারবেন না। আপনি একটু অপেক্ষা করেন, দেখি কী ব্যবস্থা করতে পারি। আর্যা বলল, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভাকে জানাতে। আমিও তাই করলাম। খবরটা শুনেই তাৎক্ষণিকভাবে কিছু অর্থ বিকাশে পাঠিয়ে দিলেন মুনিম ভাই, ফারিহা, সবুজ ভাই ও আরিফ ভাই। ফোনে আরিফ ভাই এটাও বলে দিলেন যেন অসহায় মানুষটির জন্য টিকিট কেটে তাঁকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে আসি।

রিকশাওয়ালা ভাইটিকে অর্থ সংগ্রহের খবরটি দিলাম। শুনে ওনার মুখের অভিব্যক্তি তেমন বদলায়নি। যাঁর বাবা মারা যায়, তাঁকে যে কোনোভাবেই সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। কেবল বললেন, ‘আমাকে আগে ঢাকা উদ্যান যেতে হবে, গ্যারেজে রিকশা জমা দিতে।’ আমরাও সঙ্গে চললাম। তবে ঢাকা উদ্যান পর্যন্ত যাইনি। রাত তখন সাড়ে ৮টা, মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটির সামনে নেমে বললাম, ‘আপনি রিকশা রেখে আসেন, আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।’ ১০-২০ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসবেন জানিয়ে উনি চলে গেলেন। কিন্তু সময় কেবল বাড়ছিল, ওনার দেখা নেই। রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ঘড়িতে সাড়ে ৯টা বাজে। ওই দিকে সারা দিন আমাদের তেমন খাওয়া হয়নি, আর্যা খানিক অসুস্থ। এভাবে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করি। একপর্যায়ে নিজেরাই প্রশ্ন করি, উনি কি আমাদের কাছে মিথ্যা গল্প বললেন? লোকটা আসছেন না যে? বিরক্তিবোধও চলে আসে। রাত ১০টা বেজে যায়। দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। ঢাকা শহরে আজকাল দ্রুতই আঁধার নেমে আসে। বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য সবার মধ্যেই কেমন যেন অস্থিরতা।

সিদ্ধান্ত নিলাম ফিরে আসব, দেখলাম রিকশাওয়ালা ভাইটি হেঁটে হেঁটে আসছেন। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করায় বললেন, ঢাকা উদ্যান থেকে যানবাহনে আসার মতো টাকা ছিল না। এটা শুনে নিজেকেই ধিক্কার দিলাম, তখন যদি কিছু খুচরা টাকা দিয়ে দিতাম। একটি সিএনজি ডেকে ওনাকে নিয়ে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশে রওনা হলাম। বাবার সম্পর্কে জেনে নিতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু এমন মানসিক পরিস্থিতিতে কথা বলাটা ঠিক হবে কি না! তবু জানতে চাওয়ায় বললেন, ওনার বাবা একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন। আজ নামাজ পড়তে গিয়ে হঠাৎ করেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

এরই মধ্যে কল্যাণপুর এসে পৌঁছাই। নবাবগঞ্জের টিকিট কেটে ভাইটিকে বাসে উঠিয়ে দিই। গাড়ি ছাড়ার আগপর্যন্ত সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এক বাবা লাশ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন তাঁর বড় ছেলের বাড়ি ফেরার আশায়। আমরা কেবল ওনার ছেলেকে শেষ একটি বার বাবাকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। জানি না শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর বাবাকে দেখতে পেরেছেন কি না। হয়তো দেখতে পাননি! বাড়ি পৌঁছে দেখেন জানাজা ও দাফন শেষ, প্রতিবেশী ও আত্মীয়রা ফিরে যাচ্ছেন নিজেদের গন্তব্যে!

লেখা: শিক্ষার্থী, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ও বইমেলা সম্পাদক, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা