‘জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো, আর কত দিন বল সইবো/ এবার আদেশ করো তুমি আদেশ করো ভাঙ্গনের খেলা খেলব...’। সৈয়দ আবদুল হাদী আর সাবিনা ইয়াসমীনের দরদি কণ্ঠে হৃদয় ভেদ করে উঠে আসা সুন্দর গানটির মধ্যেই ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’ চলচ্চিত্রের মূল সারমর্ম লুকিয়ে আছে। এই চলচ্চিত্রের সব গান লিখেছেন পরিচালক আমজাদ হোসেন নিজে। তিনি মননশীল লেখক বা পরিচালকের পাশাপাশি বড় মাপের একজন গীতিকারও ছিলেন। ‘একবার যদি কেউ ভালোবাসত, আমার নয়ন দুটি জলে ভাসত...’ সৈয়দ আবদুল হাদী ও সামিনা চৌধুরীর আকুল কণ্ঠে উঠে আসা বেদনাবিধুর ভালোবাসার গানটি আজও অশ্রুসজল চিত্তে মানুষের মুখে মুখে ফেরে। হৃদয়ের একূল-ওকূল দুকূল ভাসানো গানের ভাষায় আমজাদ হোসেন অমর হয়ে আছেন।
শুধু গান লিখে ছবিতে প্রতিস্থাপন নয়, সে ক্ষেত্রেও যেমন কাহিনির দৃশ্যকল্প আগে থেকে পরিচালকের চোখে ভাসত, আবার চলচ্চিত্রে দৃশ্য বা ঘটনা অনুযায়ী সফল গান লিখেও তিনি মাতিয়ে দিতে পারতেন। চারপাশের শত শত বেসুরো, ছন্দহীন গানের মধ্যে আজও যা বিরল। যেমন এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বিখ্যাত গানটি ছিল শামীমা ইয়াসমিন দিবার কণ্ঠে ‘বাবা বলে গেল, আর কোনো দিন গান কোরো না/ কেন বলে গেল, সেই কথাটি বলে গেল না...’। শিশুশিল্পী মাস্টার শামীমের অনবদ্য অভিনয়ে গানটি সুন্দর প্রাণ পেয়েছে। ছোটবেলা থেকে এসব গান শুনে বেড়ে উঠেছি। স্মৃতির ভেতর এখনো তাই সুরের ঢেউ জাগে। এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন কিংবদন্তি সুরকার আলাউদ্দিন আলী।
বেলাল চরিত্রে বুলবুল আহমেদ এবং রানু চরিত্রে ববিতা অসাধারণ অভিনয়ে আগাগোড়া এ ছবিতে আলো ছড়িয়েছেন। দুজনের চোখের চাহনি, নীরব অভিব্যক্তি মুগ্ধ করে।
চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন গানের মাস্টার। দেশ স্বাধীন করার মন্ত্রে দীক্ষিত শিল্পী বেলাল প্রতিবাদী আসরে গান করার সময় পাকিস্তান পুলিশের গুলি এসে লাগে গলায়। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে, আর সেই পঁচিশে মার্চের কালো রাতে ডাক্তার জানিয়ে দেয়, বেলাল আর কখনো গান করতে পারবে কি না জানা নেই। এ যাত্রায় প্রাণে বাঁচানো গেছে, এটাই অনেক বড় বিষয়। গোলাগুলির শব্দ ছাড়িয়ে দেশাত্মবোধক গানের সুরে চলচ্চিত্রের অভিনেতা-শিল্পী-কলাকুশলীদের নাম (টাইটেল কার্ড) পর্দায় উঠে আসে। গল্পের প্রথম যাত্রার সেই টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যেও বুকের মধ্যে মাতন জাগে। ভাঙনের মধ্যেও এ ধরনের জাগরণের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে চিন্তক আমজাদ হোসেন বরাবরই অসাধারণ দক্ষ।
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শিল্পীদের জন্য নেমে আসে দুর্ভিক্ষ। বেলাল গান করতে পারে না। কোথাও কাজ পায় না। ঘরবন্দি হয়ে বিষাদ-হতাশায় দিন কাটে। অথচ দেশ স্বাধীন করার প্রতিবাদী আন্দোলনে একদিন পাশে যারা ছিল, তাদের অনেকের আর্থিক এতটাই উন্নতি হয়েছে যে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ। সব দেখেশুনে শিল্পী ভেতরে-বাইরে আরও চুপ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের আশা এবং পরবর্তী আশাহীনতা পাশাপাশি পরিচালক তুলে নিয়ে আসেন।
বেলাল একসময় রানু নামের এক ছাত্রীকে গান শেখানোর দায়িত্ব নেয়। রানুর শিল্পপতি বাবাও একজন মুক্তি আন্দোলনের সহযোদ্ধা। তবে বেলালের গানের মাস্টার হওয়ার পেশাটাকেও ভালো চোখে দেখে না। অন্যদিকে গান শিখতে এসে ছাত্রী আদর্শবান শিক্ষকের প্রেমে পড়ে যায়।
বেলাল চরিত্রে বুলবুল আহমেদ এবং রানু চরিত্রে ববিতা অসাধারণ অভিনয়ে আগাগোড়া এ ছবিতে আলো ছড়িয়েছেন। দুজনের চোখের চাহনি, নীরব অভিব্যক্তি মুগ্ধ করে। বুলবুল আহমেদ একজন রূপদর্শী অভিনেতা। তাঁর অন্তরের সৌন্দর্য, চিন্তাভাবনার প্রতিফলন পরিস্ফুটিত হয়। সুন্দরী, বুদ্ধিদীপ্ত অভিনেত্রী ববিতার সঙ্গে রসায়ন তাই জমে ওঠে।
বেলালের ঘরে কবি সুকান্ত, নজরুলের ছবি আছে। জহির রায়হানের ছবি আছে। চিরকিশোর সুকান্তর ছবি দেখে অনেকে ভাবে ওটা বেলালের ছোটবেলার ছবি। সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টি উঠে আসে। কবি সুকান্তর সঙ্গে বুলবুল আহমেদের মুখের মিল একেবারে কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার নয়। আর জহির রায়হান পরিচালক আমজাদ হোসেনের সহযোদ্ধা। দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই যাঁকে দেশের জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। কিংবদন্তি পরিচালক সহযোদ্ধাকে মনে রেখে ঘরে তাঁর ছবি রাখা, আমজাদের প্রকৃত শ্রদ্ধার্ঘ্য। শিল্পীদের জীবনযন্ত্রণা এই ছবির পরতে পরতে।
শিল্পীদের আত্মসম্মানবোধ প্রবল। অনেকের কাছে সেটা অহংকার মনে হয়। বেলাল যেমন গানের মাস্টারের বেতন ছাড়া ছাত্রীর কাছ থেকে বাড়তি কিছু নিতে চায় না। রানুও বলে, সে এমনই একজন মর্যাদাবান শিল্পী হতে চায়।
অন্য এক সহযোদ্ধা শিল্পীর মৃত্যুতে বেলাল ভেঙে পড়ে। কাঁধে করে মরদেহ কবরে নিয়ে যায়। সেই রাতে মদ্যপান করে বাড়ি ফিরে ঘরের দরজা খুঁজে না পেয়ে সিঁড়িতে পড়ে থাকে। শিল্পীর প্রতি শিল্পীর ভালোবাসা, প্রিয়জন হারানোর যন্ত্রণা যে কতটা প্রবল, তা আক্ষরিকভাবে ফুটে ওঠে।
বেলালের প্রতি রানুর শ্রদ্ধা একসময় পরম প্রেমে পরিণত হয়। দুজনের ভালোবাসায় নতুন করে ঘর-সংসার ভরে ওঠে। শিল্পপতি বাবা–দাদার কূটচালে সোনার সংসার আবার ভেঙে যায়। সুপ্ত বিচ্ছেদ বিরহে প্রবল যন্ত্রণায় এরপর দুজনের দীর্ঘ নিঃসঙ্গ যাপন। তত দিনে দুজনের সেতু সন্তান এসেছে, সেই সন্তানকে বেলাল বড় করে তুলেছে। বেলালের বাসায় সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়েছে গ্রাম থেকে আসা বোন স্বর্ণ। স্বর্ণ চরিত্রে আনোয়ারার মাতৃত্ব অনবদ্য রূপ পেয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী আনোয়ারা প্রকৃতই ঐতিহাসিক মাতৃস্বরূপা হয়ে উঠেছেন। সন্তানের চরিত্রে মাস্টার শামীমকে ভালো লাগে। মধ্যবয়সে এসে গান শেখার পাগল ছাত্রী চরিত্রে সুমিতা দেবী বেশ প্রাণ খুলে হাসাতে পারেন।
নিঃসঙ্গ যাপনে মাদকাসক্ত বেলালের গলা দিয়ে রক্ত ওঠে। একসময় কথা বন্ধ হয়ে যায়। শিল্পীজীবনের এই দগ্ধ চরম যন্ত্রণা বাস্তবেরই প্রতিচ্ছবি। সব কথা ফুরিয়ে যায়, পরিচালক তখন আবার আশাহীনতার মধ্যে ভালোবাসার আলো জ্বালিয়ে দেন। রানু আর বেলালের মিলন–সেতু হয়ে দাঁড়ায় কিশোর সন্তান।
প্রবীর মিত্র, আশীষ কুমার লোহ, মনোজ সেনগুপ্তর অভিনয় মনে রাখার মতো। এই ছবির আলো-অন্ধকারের ক্যামেরার ভাষা একরাশ জাদু ছড়িয়ে দিয়ে যায়। শুধু শিল্পীসত্তা, শিল্পীজীবন নয়, মানব-মানবীর প্রেমকাহিনিও নয়, এই ছবি দেশপ্রেমের ছবি। দেশকে জন্ম থেকে জ্বলতে দেখার ছবি। সেই জ্বলুনির আগুন নেভাতে না পারার কষ্টের ছবি। মাতৃভূমিকে ভালোবাসার জন্য আমাদের বারবার নত মস্তকে এই ছবির সামনে, আমজাদ হোসেনের মতো পরিচালকের চিন্তাভাবনার সামনে বসতে হবে। ছবি দেখার আনন্দ এখানেই।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত