হেমন্ত ও নতুন ধানের গল্প

নতুন ধানছবি: হাসান মাহমুদ

শীতের আগমনী ঠান্ডা বাতাসই যেন টেনে নিয়ে আসে হেমন্তকে। হালকা শীত, মিহি কুয়াশা, ওপরে ঝকঝকে সুনীল আকাশ আর চারদিকে আধা পাকা সোনালি ধানখেত। এ যেন আবহমান বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ। হেমন্ত হলো ষড়্ঋতুর চতুর্থ ঋতু; যা কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের সমন্বয়ে গঠিত। শরৎকালের পর এই ঋতুর আগমন। এর পরে আসে শীত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। জনশ্রুতি আছে, ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আর্দ্রা’ নামক দুটি তারার নাম অনুসারে রাখা হয়েছে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসের নাম।

হেমন্তের রূপসৌন্দর্য আর মহত্ত্বের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে ধান। চৈত্র-বৈশাখ মাসে আমন ধানের যে বীজ বপন করা হয়, সেগুলোই অগ্রহায়ণে এসে পেকে যায়। ধু ধু বিশাল মাঠের চারদিকে শুধু ধান আর ধান। দীর্ঘ পাঁচ-ছয় মাসের হাড়ভাঙা খাটুনির পর এসব সোনারাঙা ধান দেখে চোখ জুড়ায় কৃষকদের। হেমন্তের ঝকঝকে রোদে সোনালি ধান আর মেঘমুক্ত পরিষ্কার নীল আকাশ যে কারও হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। বউ–ঝিরাও ব্যস্ত হয়ে পরে সোনার ফসল ঘরে তুলতে। ঠিক এই সময়টায় দেখা যায় বাংলার প্রকৃত গ্রামীণ দৃশ্য। চারপাশে পাকা ধানের ম–ম গন্ধে মন ভরে যায়। হেমন্তে শীতের প্রকোপ যেমন থাকে না। থাকে না কুয়াশার ঘনত্বও। হালকা শীত আর হালকা কুয়াশা। দিনে কড়া রোদ আর রাতে ঠান্ডা। প্রকৃতি যেন তার অপরূপ রূপের সবটুকু ঢেলে দেয় এ সময়।

হেমন্ত এলেই এলাকায় গাছিদের আনাগোনা দেখা যায়। তাঁরা খেজুরের রস সংগ্রহ করতে গাছ কাটেন। বিকেল হলেই খেজুরগাছের মাথায় হাঁড়ি টাঙিয়ে দেয়। আর সকাল সকাল নামিয়ে আনেন টাটকা খেজুরের রস। এই রস দিয়ে বানানো হয় সুস্বাদু খেজুরের গুড়।

এখন হেমন্তকাল। বর্ষায় জমে থাকা পানি শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সকাল হলেই কৃষকেরা কাস্তে হতে মাঠে চলে যান। ধান কাটার জন্য। রাখালিয়া গালগপ্পে তুমুল আনন্দের সঙ্গে ঘরে তুলে আনে নতুন ধান। বাড়িতে বাড়িতে ধানের স্তূপ। গৃহপালিত পশুদের মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘদিন পর কচি ঘাসে মুখ দিয়ে তাঁরাও বেশ আনন্দিত।

এরপর শুরু হয় ধানমাড়াইয়ের কাজ। এখন আর আগের মতো গরুর গাড়ি নেই। নেই গরু দিয়ে ধানমাড়াইয়ের কোনো ব্যবস্থাও। আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে ধানমাড়াই করা হয়। তবু আনন্দ–উচ্ছ্বাসের কমতি থাকে না। ধান বাঙালিদের অন্যতম আহার্য। তাই নতুন ধান ঘরে আসায় খুশিতে আবেগাপ্লুত হয়ে যায় বাড়ির শিশু-বৃদ্ধ সবাই। ধানমাড়াইয়ের পর দুই ভাগ করা হয়। এক ভাগ বিক্রির জন্য, আরেক ভাগ সেদ্ধ করে খাওয়ার উপযোগী চাল সংগ্রহ করার জন্য। ধানসংশ্লিষ্ট খরচ মেটাতেই চাষিরা ধান বিক্রি করে থাকেন। এটাই চাষিদের আয়। হাজারো ভোক্তাশ্রেণির হাতে খাবার তুলে দিতেই তাঁদের এত পরিশ্রম।

সেদ্ধ ধানের সবজুড়েই থাকে নারীদের কাজ। সেই ভোররাতে উঠে ধান সেদ্ধ করো, রোদে শুকাও। তারপর ধান ভানো। রোদে ধান শুকানোর অপরূপ দৃশ্য আন্দোলিত করে বারবার। এটা বউ–ঝিদের কাজ। পায়ের বিশেষ দক্ষতায় অত্যন্ত শৈল্পিকভাবে তাঁরা উঠানে শুকাতে দেওয়া ধান নাড়েন। এভাবে কয়েক দিন শুকানোর প্রক্রিয়া চলার পর আসে ধান হতে চাল বের করার কাজ।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে ঐতিহ্যগতভাবে জড়িয়ে আছে ঢেঁকির নাম। সারা দিন-সারা রাত চলত ঢেঁকিতে ধান ভানার কাজ। মেয়েরা সদলবল ঢেঁকিতে পা চালাত। তাদের সাহায্য করত পুরুষেরাও। আধুনিক শিল্পবিপ্লবের জোরে বিলুপ্তির পথে ঢেঁকি। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে থাকা ঢেঁকি এখন কয়েক গ্রাম খুঁজলেও পাওয়া মুশকিল। কত কিছুই তো হারিয়ে গেছে। পুরোনো অনেক কিছুই বদলে গেছে নতুনত্বের ছোঁয়ায়। তবু ফেলে আসা গ্রামের মধুর স্মৃতি বারবার ফিরে আসে।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম