শিশুদের প্রতি কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার ভালোবাসা
‘বড় বড় নামকরা স্কুলের বাচ্চারা বিদ্যার চেয়ে অহংকারটা বেশি শিখে।’
‘আমার পরিবার চাষা। আমার পক্ষে এটা ওভারলুক করা কষ্টকর, রং চড়িয়ে কিছু বলতে চাই না। আমার পূর্বপুরুষেরা সরাসরি কৃষি উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিল, এই পরিচয় আমার অহংকার।’
কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার উক্তিগুলো হৃদয় স্পর্শ করে। বাংলার সক্রেটিসখ্যাত ছফাকে আমরা কতটা মনে রেখেছি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, লেখকের গ্রাম চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়ায় তাঁর কোনো স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত নেই।
আহমদ ছফাকে আমরা দেখতে পাই একজন প্রকৃত স্পষ্টবাদী ও শিশুপ্রেমী হিসেবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। এ বিষয়ে কথা বলেছিলাম লেখক ও বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দেশে প্রথম কি না বলতে পারছি না। তবে এই স্কুল তিনি শুরু করেন ১৯৭৬ সালের পরে। নাজিম উদ্দিন ছিলেন তাঁর প্রধান সহযোগী। শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র ছিল স্কুলের আদি নাম। আহমদ ছফার জীবনাবসানের পর স্কুলটির নাম রাখা হয় ছফা-সুলতান পাঠশালা।’
আশির দশকেও ঢাকার কাঁটাবন বস্তিতে শিশুদের জন্য ‘শিল্পী এস এম সুলতান কর্মশালা’ নামেও একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আহমদ ছফা। শিশুদের নিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা ছেলেমেয়েদের যখন পড়াতে শুরু করলাম, একটা কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হলো। বস্তির শিশুদের মুখ থেকে অনর্গল অশ্লীল বুলি নির্গত হয়। একজন আরেকজনকে মা-বাবা তুলে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করে যে শুনলে কানে হাত দিতে হয়। এক শিশুকে জিজ্ঞেস করা হয় তার বাবা-মা কী করে? পাশের শিশু জবাব দেয় অর বাপ ছিঁচকা চোর। এক মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হয় তার মা কী করে। পাশে বসা মেয়েটি কালবিলম্ব না করেই জবাব দিয়েছিল অর মা খারাপ কাম করে।’
গত ১৭ জানুয়ারি শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ গেট মিরপুর-১ তে আহমদ ছফার পালিত পুত্র সুশীলচন্দ্র সিংহের তত্ত্বাবধানে শিশুদের জন্য ‘আহমদ ছফা শিশু শিক্ষানিকেতন’ নামে নতুন করে যাত্রা শুরু করে একটি স্কুল। উদ্বোধক ছিলেন আহমদ ছফার ভাতিজা লেখক ও গবেষক নূরুল আনোয়ার, ড. চিন্ময় হাওলাদার ও সৌভাগ্যক্রমে আমিও দাওয়াত পেয়েছিলাম।
সুশীলচন্দ্র সিংহ সহজ–সরল বিনয়ী মানুষ। একটা এনজিওতে কাজ করতেন। তাঁর স্বপ্ন বিদ্যালয়টি একদিন প্রতিষ্ঠা পাবে। শিশুরা এখান থেকে বিদ্যার্জন করবে। সুশীলের বাড়ি ঠাকুরগাঁও জেলায়। রাজবংশীয় হিন্দু সম্প্রদায় পরবর্তী সময়ে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। তিনি আহমদ ছফাকে দেখাশোনা করতেন। রান্নাবান্নাও করে খাওয়াতেন। আহমদ ছফা সুশীলকে বাবা বলে সম্বোধন করতেন, সুশীল ডাকতেন স্যার। ছফার কাছে থেকে তিনি ডিগ্রি ও মাস্টার্স পাস করেন। সুশীলের কিছু ঘাড় ত্যাড়ামিও আছে, অনেকটা একগুঁয়েমি রাগী স্বভাবের। তিনিও খুব স্পষ্টবাদী। এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় তাঁর এক সহকর্মী আহমদ ছফাকে নিয়ে কটূক্তি করায় তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। সুশীল জীবনসঙ্গী করেছেন এক চাকমা মেয়েকে। নিঃসন্তান দম্পতি। তাঁর স্ত্রী একজন বিউটিশিয়ান, ছোট একটা পারলার চালান।
লেখক আহমদ ছফা আলমগীর নামে এক অনাথ শিশুকে বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করলে সে বলেছিল হাসপাতালে। বাবা-মা সবকিছু হাসপাতালে। ছফার মায়া হলো। তিনি আলমগীরের জন্য তোশক কিনে দিলেন। জামাকাপড় বানিয়ে দিলেন, স্যান্ডেল কিনে দিলেন। আলমগীর মনের আনন্দে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, পাঠশালায় যাচ্ছে। আলমগীরকে লেখক চোখে চোখে রাখতেন, যেখানে যেতেন, সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন।
মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি স্কুল পরিচালনা করে গেছেন। ছফা-সুলতান পাঠশালায় সঙ্গে অনেক বড় বড় সাংবাদিক, সাহিত্যিক-কবিরা জড়িত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেটি আর টিকিয়ে রাখা যায়নি।
প্রিয় লেখক আহমদ ছফা নেই। নিজের হাতে গড়া সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের স্কুলও কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে। কিন্তু পালক পুত্র সুশীলরা বেঁচে আছেন বলে আজকের ‘আহমদ ছফা শিশু শিক্ষানিকেতন’ নতুন করে স্বপ্ন দেখে।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা