আনোয়ার গেল ধানমন্ডি ৩২

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়ি। এটি এখন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। ছবি: সংগৃহীত

আনোয়ার গত সপ্তাহে কানাডা থেকে দেশে এসেছে। সেখানে সে একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। প্রথমবার বাংলাদেশে আসা, পিতার জন্মদাত্রীর খোঁজে। গত বছর ১ আগস্টে মাত্র ৫১ বছর বয়সে তাঁর পিতা পিটার জনসন মারা যান। স্ট্রোক করে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মাথায় তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। মৃত্যুর আগে আনোয়ারকে বলে যান জীবনের এক কষ্টের গল্প।

পিটার জনসন ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেওয়া এক দুর্ভাগা যুদ্ধশিশু। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পরে অনেক যুদ্ধশিশুকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দত্তক হিসেবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা ছিল নারীদের ওপর বীভৎস পাশবিক যৌন নির্যাতন চালানো। দীর্ঘ ৯ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে সম্ভ্রম হারান দুই লক্ষাধিক মা-বোন। তাঁদের গর্ভে জন্ম নেয় পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের ঔরসজাত সন্তান।

দেশ স্বাধীন হলে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সব নারীকে বীরাঙ্গনা উপাধিতে সম্মানিত করেন। বীরাঙ্গনাদের গর্ভে জন্ম নেওয়া অসংখ্য শিশুকে বিদেশিরা দত্তক নিয়ে নেন। পিটার জনসনের পালক পিতা স্যামুয়েল জনসন পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। ১৯৭১-এ কানাডার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থন এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি বাংলাদেশি এক চিকিৎসক বন্ধুর মাধ্যমে আনোয়ারের পিতাকে দত্তক নেন। স্যামুয়েল জনসনের স্টাডি রুমেও আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। ছোটবেলা থেকেই দাদুর পড়ার ঘরে টানানো এই ছবির প্রতি এক অজানা আকর্ষণ অনুভব করত আনোয়ার। যাঁর মুখের দিকে তাকালেই একধরনের শ্রদ্ধাবোধ জেগে ওঠে। কিন্তু তাঁকে নিয়ে জানার আগ্রহ আগে আনোয়ারের কখনো হয়নি।

পিতা পিটার জনসনের মুখে যখন আনোয়ার জানতে পারে তার দাদি ছিলেন একাত্তরের সেই নির্যাতিতা নারীদের একজন, তখন সে হঠাৎ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে। খুব জানতে ইচ্ছা করে কে তাঁর দাদী! আনোয়ারের জন্মের সময় মা মারা যান, তাই মায়ের আদর কোনোদিন পায়নি সে। তবে বাবার ভালোবাসায় এতটুকু কমতি রাখেননি পিটার জনসন। তিনি ছিলেন থিয়েটার অভিনেতা। অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল বাংলা ভাষায় একটি নাটক নির্মাণের। কিন্তু সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।

মিস্টার পিটারের পিতা স্যামুয়েল জনসন জীবনের বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে গেছেন বলে তাঁর বাংলা উচ্চারণ সাবলীল। পিটারও বাংলায় ছিলের বেশ পারদর্শী। আনোয়ারও তাই বাবা, দাদুর কাছ থেকে শিখে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে। যদিও কথা বলায় সে খুব একটা সাবলীল না, তবে শুনলে বুঝতে পারে।

পিটার জনসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে বইপত্র, পত্রিকার লেখা সংগ্রহ করে তা পড়তেন৷ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ পড়ে তিনি এতটাই মুগ্ধ হন যে উপন্যাসের লেখক আনোয়ার পাশার নামে নিজের সন্তানের নাম রাখেন ‘আনোয়ার’। লেখক আনোয়ার পাশা মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন।

পিটার জনসনের মৃত্যুর পর আনোয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশে এসে পিতার জন্মদায়িনী মাকে খুঁজে বের করবে, যাঁর খোঁজ তাঁর পিতা পিটার জেনে যেতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি পেতে কিছুটা দেরি হওয়ায় আসতে এক বছর লাগল। বাংলাদেশে আসার আগেই আনোয়ার ঠিক করে এসেছিল, প্রথমেই সে যাবে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। কিন্তু প্রথমেই সেখানে যাওয়া হলো না, আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে অনেকটা বেগ পেতে হলো। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠার পর রাত থেকেই প্রচণ্ড জ্বর। সুস্থ হতে এক সপ্তাহ লেগে গেল। কানাডায় তেমন মাছ খাওয়া হতো না। বাংলাদেশে প্রথম দিনই রুই মাছের দোপেঁয়াজা খেতে গিয়ে মাছের আঁশটে গন্ধে হড়হড় করে বমি করে দিল। তার পরদিন শর্ষে ইলিশ খেতে গেলেও সে খেতে পারেনি। পরে আর মাছ খাওয়ার চেষ্টা করেনি আনোয়ার।

সুস্থ হয়েই সে হোটেলের একজন গাইডকে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরতে বের হয়। যতটা অনুন্নত হবে ভেবেছিল, ততটা তার মনে হলো না। অনেক বড় বড় দালান, শপিং মল, ফ্লাইওভার, রাস্তায় রংবেরঙের বাতি—এসব দেখে বেশ ভালোই লাগছিল। ঘুরতে ঘুরতে চলে এল ধানমন্ডি ৩২ নম্বর লেকের ধারে। সেখানে দুজন বৃদ্ধ নারীকে ফুলের মালা হাতে হেঁটে যেতে দেখল। তাঁদের পরনে সাদা শাড়ি পরা আর শাড়ির আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছছেন। এখানেই তো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক বাড়ি।

আনোয়ার দুজন বয়স্ক নারীকে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ অবাক হলো। সে তাঁদের পিছু পিছু যেতে লাগল। গাইডকে জিজ্ঞেস করল, ‘হেই, হোয়াই দে আর ক্রাইং?’ গাইড বললেন, ‘আমিও বুঝতে পারছি না স্যার।’ আনোয়ার তাঁদের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এক্সকিউজ মি! হোয়াই আর ইউ ক্রাইং?’ গাইড তখন ওই নারী দুজনকে প্রশ্নটি বাংলায় অনুবাদ করে দিলে একজন বললেন, ‘দাদুভাই, আমরা দুই বান্ধবী। আমার নাম গীতা রাণী দাস। তুমি কি মুক্তিযুদ্ধের কথা জানো?’ আনোয়ার বলল, ‘ইয়েস মাই গ্র্যান্ডমাদার ইস অলসো আ ভিকটিম অব দ্য ওয়ার।’ গীতা রাণী বললেন, ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ক্যাম্পে আটকে রেখে অনেক নির্যাতন করে। কিছুই খেতে দিত না, অনেক মারত। আমার বাবা আগেই মারা গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ফিরে এলে মা আমাকে বুকে টেনে নিলেও ভাইয়েরা মেরে তাড়িয়ে দেয়। আর ওর সঙ্গেও আমার আগে পরিচয় ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একঘরে বন্দী ছিলাম। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি আমরা দাদুভাই।’ এই বলে তিনি আঁচলে চোখ মুছলেন।

অপর নারী বললেন, ‘আমার নাম রাহেলা খাতুন। তখন এক মাস হয় আমাদের বিয়ে হয়েছিল। স্বামী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। উনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, এরপর আর ফিরে আসেননি। বেঁচে আছে না মরে গেছেন, তা–ও জানি না। রাজাকাররা আমাকে মিলিটারিদের হাতে তুলে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই হয়নি। বাবাও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল, তার নাকি আমাকে মেয়ে বলে পরিচয় দিতেও ঘেন্না হয়। তখন শেখ সাহেব আমাদের বীরাঙ্গনা বলে সম্মান দেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মতো যেসব হতভাগী মেয়ের কোনো বাড়ি নেই, যাদের বাবা তাদের ত্যাগ করেছে, তারা যেন পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান আর ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ লিখে দিই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, মানুষটাকে ওরা বাঁচতে দিল না। এরপর আমাদের আর কেউ ভালোবাসে নাই।’

গীতা রাণী বললেন, ‘প্রতিবছর স্বাধীনতার মাসে আমরা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে এসে নিজের হাতে গাঁথা ফুলের মালা দিয়ে পিতাকে নমস্কার করি। আমি যে বাবা হারিয়ে বাবা পেয়েছিলাম।’ রাহেলা খাতুন আনোয়ারের হাতে ফুলের মালা দিয়ে বললেন, ‘দাদুভাই, এই ফুলের মালাটা তুমি নাও। দোয়া করি যেন এই দেশকে গর্বিত করতে পারো।’ আনোয়ার তখন আস্তে আস্তে হেঁটে ফুলের মালাটা বঙ্গবন্ধুর ছবির সামনে এনে রাখল, যার পাশে লেখা ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের কবিতা, ‘যতকাল রবে পদ্মা, যমুনা, গৌরী, মেঘনা বহমান। ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’ আনোয়ারের বলতে ইচ্ছা করল অনেক কথাই; কিন্তু কিছুই বলতে পারল না। দুই চোখ বারবার ভিজে উঠছিল।

জন্মের পর কোনো দিন মায়ের ভালোবাসা পায়নি, যে বাবা তাকে এত কষ্ট করে মানুষ করলেন তাঁর জীবনও কেটেছে মায়ের আদর ছাড়া। মা ছিলেন যুদ্ধের সেই মহীয়সী নারী; যাঁর আর্তনাদের বিনিময়ে আজও বেজে ওঠে জাতীয় সংগীত, ‘আমার সোনার বাংলা’। আনোয়ার তাই গীতা রাণী আর রাহেলা খাতুনের মাঝেই খুঁজে পেল তার দাদিমার প্রতিচ্ছবি। শেষ বিকেলের আলোতে বীরাঙ্গনা গীতা রাণী ও রাহেলা খাতুনের চোখ জলে ভরে উঠল, যেন ওঁরা চোখের জলে আনোয়ারকে আশীর্বাদ করলেন।

সাবেক মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা