দেশকে দুর্নীতি আর কালোবাজারি মুক্ত করতে ‘আলোর মিছিল’

আলোর মিছিল ছবির দৃশ্যছবি: সংগৃহীত
আলো নামের একটি মেয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনি শেষ হয়। এই দুঃখের কাহিনি আর সংলাপ বুনেছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ। বাপ-মা মরা আলো নামের মেয়েটি মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু, মামা-মামি সবার কাছে সে বড় প্রিয়। সে গান জানে, নাচ শেখে।

বাংলার মানুষ অনেক স্বপ্ন নিয়ে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল। ৩০ লাখ মানুষের রক্ত, প্রাণ বলিদান, মা-বোনের সম্ভ্রম এবং হাজার হাজার দেশছাড়া উদ্বাস্তু মানুষের তিলে তিলে মৃত্যু, নিদারুণ কষ্টের বিনিময়ে বহু প্রতীক্ষিত স্বাধীনতা এল।

কিন্তু সদ্যোজাত স্বাধীন দেশে যখন ঠিকঠাক পরিচালনার পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি, ধ্বংসস্তূপে আলোর সন্ধানে মুক্তিকামীরা লড়ছে। চারদিকে অভাব-অনটন, দারিদ্র্য, নিত্য গ্রাস করছে; ঠিক তখনই দেশের ভেতরেই একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কালোবাজারি ব্যবসায়ী রাতারাতি ধনী হতে লাগল। সমাজের সুবিধাবাদী, লোভী এই মানুষেরা শুধু নিজের ক্ষমতা, বিত্ত, প্রতিপত্তির জন্য দেশকে প্রতিনিয়ত হাঙরের মতো গিলে ফেলতে চাইল। মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যাশা, প্রাপ্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ যন্ত্রণা—এই সবকিছু নিয়েই ১৯৭৪ সালে নারায়ণ ঘোষ মিতার পরিচালনায় মুক্তি পায় চলচ্চিত্র আলোর মিছিল।

আলো নামের একটি মেয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনি শেষ হয়। এই দুঃখের কাহিনি আর সংলাপ বুনেছিলেন ইসমাইল মোহাম্মদ। বাপ-মা মরা আলো নামের মেয়েটি মামাবাড়িতে মানুষ। দাদু, মামা-মামি সবার কাছে সে বড় প্রিয়। সে গান জানে, নাচ শেখে। তার ঠোঁটে সাবিনা ইয়াসমীনের কালজয়ী বেদনার গান, ‘এই পৃথিবীর পরে/ কত ফুল ফোটে আর ঝরে/ সে কথা কি কোনো দিন/ কখনো কারও মনে পড়ে...’ ভোলা যায় না।

দাদু, মামা-মামি এবং সদ্য প্রেমে পড়া হাফ ইঞ্জিনিয়ার যুবকের সোহাগে-আদরে-আহ্লাদে; পড়াশোনা, নাচগানের অনুশীলনে ভালোই চলছিল আলোর জীবন। কিন্তু ৪০০ টাকা মাইনের কেরানি বড় মামা আলিম, যুদ্ধপরবর্তী সময়ে হঠাৎ বড়লোক হওয়ার বাসনায় কালোবাজারির ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়ে। দেশের মানুষের অন্ন জোটে না, তখন সে এবং তার মতো অনেকেই চাল থেকে ওষুধ—সবকিছু মজুত করে চড়া দামে বিক্রি করতে থাকে। রাতারাতি লাখ লাখ টাকা হাতে ওঠে আসে। বাড়ির রং বদলায়, অবস্থা বদলায়; নতুন টিভি, টেলিফোন, আসবাব কত কিছু আসে। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ নষ্ট হয়ে যায়।

ছোট মামা রানা বিদেশ থেকে ফিরে বাকি পড়াশোনা, ভালো চাকরিতে মন না দিয়ে দেশের কাজে যুক্ত হয়। এই কাজে তাঁকে উৎসাহিত করে দাদা আলিমের একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু পরিবারের সবার প্রিয় মানুষ শহীদ আশরাফ।

আশরাফ দেশ অন্তঃপ্রাণ মানুষ। ১৯৬৯ সালে লড়াকু ছাত্রনেতা থেকে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু দেশ স্বাধীন করার পরও নিজের জীবনে সচ্ছলতা ভোগ-সুখ-পরিবর্তন কিছুই আসে না। ছোট্ট বেড়ার ঘরে থেকে ত্যাগী জীবনে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করেন, আলোর পথে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে সে এখনো ব্রতী। কালোবাজারিদের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই-সংগ্রামের পথে রানার মতো ছাত্র-যুবদের অনেককে পাশে পেয়ে যায়।

সেই সময়কার আরও বেশ কিছু মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার অভিনয়ে অনবদ্য আনোয়ার হোসেন; এই চলচ্চিত্রে শহীদ আশরাফ চরিত্রেও যথাযথ। আনোয়ার হোসেনের মুখে সংলাপ শুনলে বুকের ভেতরে এখনো একটা দেশ জেগে ওঠে। যে দেশের জন্য আমরা অনেকেই এখনো কাঁদি। যে দেশকে আমরা মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসি। রানা চরিত্রে রাজ্জাক, আলো চরিত্রে ববিতা, আলিম চরিত্রে খলিল উল্লাহ, আলিমের স্ত্রী মীনা চরিত্রে রোজী আফসারী, আলোর দাদু নারায়ণ চক্রবর্তী, রানার প্রেমিকা দিনার চরিত্রে সুজাতা—সবার অভিনয় মনে রাখার মতো।

হঠাৎ বড়লোক হওয়া আলিমের বেপরোয়া জীবন ছোট ভাই রানাকেও ঘর ছাড়তে বাধ্য করে। রানা কিছুতেই দেশসেবা বাদ দিয়ে ধনী পরিবারের প্রেমিকাকেও বিয়ে করতে রাজি নয়। এই প্রেমিকা দিনার বাবা অন্য এক কালোবাজারি পুঁজিপতি। রানা যদি এসব লড়াই-সংঘাতের পথ ছেড়ে দেয়, তবে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিতে দিনার বাবা প্রস্তুত।

আশরাফ ও রানার মতো নেতাদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদে দিকে দিকে মজুতদারদের বিরুদ্ধে কণ্ঠ ধ্বনিত হতে থাকে। দুর্নীতিবাজদের স্বার্থে প্রবল আঘাত লাগে। এই কালোবাজারি মজুতদার-পুঁজিপতিরা ছলে-বলে-কৌশলে প্রতিবাদকে ছত্রভঙ্গ করতে চায়। ভাই ও বন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করতেও আলিমের মতো কালোবাজারি অসৎ ব্যবসায়ীদের বিবেকে বাধে না।

প্রতিবাদীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে রানাকে হত্যা করা হবে, দিনার মুখে এ খবর জানতে পেরে মীনা তৎক্ষণাৎ আলোকে সেখানে পাঠায়। রানা মঞ্চে গান করছিল। নিজেদের প্রতিবাদী বন্ধুবৃত্তের বিশ্বাসঘাতক কয়েকজন তলে-তলে অর্থের বিনিময়ে তত দিনে কালোবাজারি আলিমদের কাছে বিকিয়ে গেছে, কেউ তা জানে না। তারাই এখন রানাকে হত্যা করবে।

আলো ছুটতে ছুটতে মঞ্চে চলে আসাতে তার বুকে গুলি লাগে। কিন্তু একটি আলোর বৃত্ত তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশকে দুর্নীতি আর কালোবাজারিমুক্ত করতে মৃত আলোকে নিয়ে এবার শোককাতর আলোর মিছিল।

মুক্তিযুদ্ধের দেশে যেন আবার একটি মুক্তিযুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে শহীদ হলেন সুন্দর, চঞ্চলা, সৃজনশীল আলো। এক শহীদের রক্তের বিনিময়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল আলো। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই চলচ্চিত্রের বিবেকদংশন কিছু মানুষকে আজও কাঁদাবে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন আজও প্রতিনিয়ত ধ্বংস হয়ে চলেছে। ধুলায় লুণ্ঠিত হয়ে চলেছে। আজকের মুক্তিযোদ্ধাদেরও তাই লড়াই করার প্রেরণা জোগাবে এই আলোর মিছিল।

আবার যাঁরা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন, তাঁরাও যেমন যোদ্ধা; যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ভিন্ন ভিন্ন ভাবনায় দেশ ও দশের জন্য কবিতা, গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, ছবি এঁকেছেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন; তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা। নারায়ণ ঘোষ মিতা তেমনই একজন বোদ্ধা পরিচালক। এই চলচ্চিত্রের সুর করেছেন খান আতাউর রহমান, গান লিখেছেন মুস্তাফিজুর রহমান, সংগীত পরিচালনা করেছেন সত্য সাহা। সবার মিলিত এই সৃষ্টি চিরকালের একটি আলোকস্তম্ভ। একটি মনের মিছিল।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত