সময়টা আজ থেকে চার বছর আগের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরিক্ষা দিতে যাই। চবিতে পড়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তবু একটা দারুণ ভ্রমণ আর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাকে না করি কীভাবে! ছোটবেলা থেকেই আম্মুর কাছ থেকে শুনেছি, যে কেউ নাকি খুব সহজেই চট্টগ্রামের মায়ায় পড়ে যায়। অবশ্য মায়ায় পড়তে বিশাল মন আর আকাশছোঁয়া ভালোবাসা প্রয়োজন। আমার আছে কি না, তা যথেষ্ট সন্দেহের।
ঢাকা থেকে বাইরে খুব একটা যাওয়া হয় না। নামমাত্র একটা গ্রামের বাড়ি আছে কুড়িগ্রামে। শেষ কবে গিয়েছি, মনে নেই। শুনেছি, কুড়িগ্রামে কেউ থাকতে চায় না। কেন থাকতে চায় না, তা জানা হয়নি কখনো। অবশ্য থাকতে চাইবেই–বা কেন? পুরো বাংলাদেশ যখন ঢাকামুখী, তখন বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া কুড়িগ্রামে থাকবেই–বা কেন?
এসব প্রসঙ্গ উঠলেই আবার আব্বুর ভীষণ গায়ে লাগত। তিনি বলতেন, ‘নদী অঞ্চলের মানুষের মন নদীর মতোই বিশাল হয়। তারা আগলে রাখতে জানে সবাইকে। এই যন্ত্রের শহরে বিশাল মনের মানুষ তো দূর, একটা হাসিখুশি মানুষ পাওয়াও দুষ্কর। হাসিখুশি মানুষ নেই বলেই চারদিকে এত ভালোবাসার হাহাকার। যা দেখবি সবই মরীচিকা।’
এসব কথা শুনলেই আমি কেমন যেন হয়ে যাই। হুমায়ূন আহমেদের বই ব্যতীত অন্য কোনোভাবে ভালোবাসা জিনিসটা উপলব্ধি করিনি কখনো। তবে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম সেদিন শরৎচন্দ্রের চট্টোপাধ্যায়ের ‘পরিণীতা’ বইটা হাতে নিয়ে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব একটা রূপ আছে, যা আর দশটা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে আলাদা করে রাখে। এত এত শিক্ষার্থী, চারদিকে কোলাহল, তবু যেন একধরনের স্বস্তি আছে।
কভার পেজটা ওলটানোমাত্রই দেখি, উৎসর্গ পেজে দুই লাইন সুন্দর হাতের লেখা!
‘আসলে মুনা, আমরা সব সময় সঠিক মানুষকেই ভালোবাসি। শুধু বুঝতে পারি না। হয়তো বুঝতে পারি না বলেই ভালোবাসা এতটা সুন্দর। ভালোবাসা হলো অযত্নে বেড়ে ওঠা পদ্মফুলের মতো। রাজপ্রাসাদের পদ্মপাড় বা গোবরে পোরা কালদিঘি—সবখানেই সে তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। সে তো মস্তিষ্ক আমাদের শত্রু যে কিনা পরিবেশনার প্রেমে পড়ে।’—কাব্যিক
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েই দেখি, এক বুক হতাশা নিয়ে বের হচ্ছে সবাই। আমি হতাশ ছিলাম না। ভর্তিযুদ্ধের সফলতাটুকু খুঁজে পেয়েছি এই তো কিছুদিন আগেই। আনন্দের সঙ্গেই হাঁটছিলাম আমি আর অর্পিতা। অর্পিতা বেশ আশাবাদী, সে চান্স পেয়ে যাবে। হঠাৎ মেঘ ডেকে ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। দুজনের আনন্দ যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। দৌড়ে গিয়ে একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে দাঁড়ালাম। অর্পিতা বলল, ‘ইশ্! এক কাপ চায়ের দরকার ছিল রে। ঝুম বৃষ্টি, এক কাপ চা আর শরৎচন্দ্র। ব্যস, আর কী লাগে জীবনে?’
‘শরৎচন্দ্র কেন?’
অর্পিতা নানাভাবে কী সব বিশ্লেষণ করছিল। আমার সেদিকে মন নেই। চোখ আটকে গেল মেরুন রঙে আঁকা ‘পরিণীতা’ বইটির ওপর। লিখেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। হাতে নিয়ে দেখতেই হয় বইটা।
কভার পেজটা ওলটানোমাত্রই দেখি, উৎসর্গ পেজে দুই লাইন সুন্দর হাতের লেখা!
‘আসলে মুনা, আমরা সব সময় সঠিক মানুষকেই ভালোবাসি। শুধু বুঝতে পারি না। হয়তো বুঝতে পারি না বলেই ভালোবাসা এতটা সুন্দর। ভালোবাসা হলো অযত্নে বেড়ে ওঠা পদ্মফুলের মতো। রাজপ্রাসাদের পদ্মপাড় বা গোবরে পোরা কালদিঘি—সবখানেই সে তার সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেয়। সে তো মস্তিষ্ক আমাদের শত্রু যে কিনা পরিবেশনার প্রেমে পড়ে।’—কাব্যিক
লেখাটি পড়ে বেশ বিমোহিত হলাম। একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বইটা কিনে নিলাম। এদিকে অর্পিতা এখনো শরৎচন্দ্র থেকে বেরোতে পারেনি। এ জন্যই হয়তো মানুষ বলে, ভর্তি পরীক্ষার্থীদের কোনো প্রশ্ন করতে হয় না।
‘এই দেখ!’
‘ওয়াও “পরিণীতা”! তুই জানিস না এটা আমার অনেক পছন্দের একটা বই। আই জাস্ট লাভ দিস বুক।’
অর্পিতা বইটা পেয়ে আরও বহু বাক্য বলে শোনাল। আমি তার দিকে মন দিয়ে বিভোর হয়ে চিন্তা করছিলাম, কে এই কাব্যিক? যার কথা এত সুন্দর, সে মানুষ হিসেবে কেমন হবে?
‘এই রিমু? কী হলো?’
‘কিছু না রে! এই লাইনগুলো দেখ। কী দারুণ লিখেছেন না?’
‘হ্যাঁ! কেমন একটা মায়া জড়িয়ে আছে, তাই না?’
‘হুম! হুমায়ূন আহমেদ যা বলেননি, তা মনে হচ্ছে উনিই বলে দিলেন। লোকটাকে যদি দেখতে পেতাম!’
‘থাম!’
এই বলে অর্পিতা ওর মুঠোফোন বের করে ফেসবুকে গিয়ে কাব্যিক লিখে সার্চ দেয়। অনেক কিছুই এল। এর মধ্য থেকে ওনাকে বের করব কীভাবে, মাথায় আসছে না।
রিমু বলল, ‘দেখ, এটা চবির একটা দোকান থেকে নিলি। তার মানে এখানকার কেউ একজন এটা বিক্রি করেছে। তাই আমাদের শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের কারও আইডি দেখতে হবে।’
এভাবে খুঁজে বেশ কয়েকজনকে পেয়েও গেলাম। অর্পিতা সব কটিতে বইটা নিয়ে কথা বলতে চেয়ে বার্তা পাঠায়। সঙ্গে সঙ্গে দু-তিনজন জবাবও দেয়। তবে তারা জানে না বইটা সম্পর্কে।
আমরা হতাশ হয়ে হোটেলে ফিরে আসি। হোটেলে এসে আব্বু আর আঙ্কেল আমাদের পরীক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্ন করেন। অর্পিতা গড়গড় করে সব বলা শুরু করল। আমি চুপচাপ হয়ে ভাবছিলাম শুধু লাইনগুলোর কথা। কেন আমার এত ভালো লাগল? কেনই–বা আমি খুঁজছি? খুঁজে পেলেই–বা লাভ কী? সবকিছুর উত্তর একটাই, জানি না।
অর্পিতার পরদিন আরেক অনুষদে পরীক্ষা আছে। তাই থাকতে হচ্ছে পরদিন পর্যন্ত। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কিছু করার ইচ্ছা করছিল না। খাওয়া শেষ করেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
বিকেলে হুট করেই একটা হাতের স্পর্শে চমকে উঠি। দেখি অর্পিতা।
‘কতক্ষণ ধরে ডাকছি, উঠিস না কেন?’
‘বল।’
‘এই দেখ একজন কী উত্তর দিয়েছে। আমার বই ওটা। আপনি কীভাবে পেলেন?’
‘তো বল ওনাকে?’
‘থাম বলছি।’
অর্পিতা ওনার সঙ্গে কথা বলছিলেন বইটা নিয়ে। একপর্যায়ে লেখাটা নিয়েও কথা শুরু হয়।
‘লেখাটি আপনি লিখেছেন?’
‘নাহ্! আমার নাম কাব্য। অন্তরা আমাকে কাব্যিক বলে ডাকত। বইটা আমি অন্তরাকে উপহার ও প্রশ্নের উত্তর হিসেবে দিই। আমার বন্ধু নিলয় এই পদ্ধতি চালু করেছে। প্রতিটা উপহারের সঙ্গে হয় কিছু প্রশ্ন নাহয় উত্তর দেবে। লেখাটাও নিলয় দিত। আর এই লেখাটাও নিলয় লিখেছে। এক বছর হতে চলল অন্তরার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। আজ বুঝতে পারলাম, সে আমার দেওয়া স্মৃতিগুলো ভেলায় ভাসিয়ে দিয়েছে।’
‘আমি দুঃখিত! আসলে লেখাটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। তাই কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করেছি।’
‘সমস্যা নেই।’
‘আচ্ছা, নিলয় ভাইয়ার সঙ্গে কি কথা বলা যাবে?’
এরপর আর জবাব নেই। অর্পিতাও বিরক্ত হয়ে বই নিয়ে পড়ে। আর আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকি, আমরা কি আসলেই ভুল মানুষকে ভালোবাসি? বাবার বলা মানুষগুলো কি আদৌ বর্তমান সমাজে অবস্থান করে? নাকি তারা ডাইনোসরের যুগেই হারিয়ে গেছে? এমন অদ্ভুত সব প্রশ্ন এসে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে! শেষে নিজেরই হাসি পেল। দেখলাম, অর্পিতা আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
সময় তখন রাত ৯টা ৪৫। ১০টায় ঘুমিয়ে পড়তে হবে। অর্পিতা আবার বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে পারে না। আর আমি বিপরীত। সাধারণত কিছু একটা পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু কাল অর্পিতার পরীক্ষা, তাই আমার কিছু করার ছিল না। হুট করেই মনে হলো, ধুর, একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রাখলে ভালো হতো। শুনতে অবাক শোনালেও আমি এ যুগে এসেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করি না।
দেখছি, অর্পিতা একটা করে মেসেজ দেখছে আর হাসছে নিজে থেকেই! একটু চোখ বুঝতেই আবার ডাক।
‘এই দেখ উনি উত্তর দিয়েছেন, “নিলয়ের ফেসবুক নেই। সে এসব পছন্দ করে না। তবে তার নম্বর নিতেই পারেন। অবশ্য রাত ১০টার পরে তাকে আর পাবেন না। সময় নিয়ে সে খুবই সতর্ক।”’
‘এখন তো ৫৫ বাজে। এত রাতে ফোন দেওয়াটা কি ঠিক হবে?’
‘আরে থাম! কল দিই আগে, কী হবে পরে দেখা যাবে।’
অর্পিতাকে বারণ করা সত্ত্বেও কল দিল। আমি ভাবছিলাম, এটা কি নিতান্তই কাকতালীয়, নাকি অন্য কিছু? তাঁর সঙ্গে এভাবে মিলে যাচ্ছে কেন?
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম!’
‘জি, ওয়ালাইকুম আসসালাম! কে বলছেন?’
‘আমাকে ঠিক চিনবেন না আপনি। আপনার বন্ধু কাব্য ভাইয়ের কাছ থেকে আপনার নম্বরটি পেয়েছি। মূলত “পরিণীতা” বইয়ের ওপর একটা লেখা দেখেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া। একটু কথা বলা যাবে?’
‘হ্যাঁ, বলুন। তবে আপনি ৫৭–তে কল দিয়েছেন। আর আমি ১০টার পরে কারও সঙ্গে কথা বলি না। তাই যা বলার এই ৩ মিনিটের মধ্যেই বলুন।’
‘আমি ঠিক কী বলব, বুঝে উঠতে পারছি না। আচ্ছা, আপনার কাছে কি আসলেই মনে হয়, আমাদের ভালোবাসা সঠিক মানুষের সঙ্গে হয়?’
‘হ্যাঁ। যদি আপনি আসলেই ভালোবাসেন, তবে সৃষ্টিকর্তা সেটা সঠিক মানুষের জন্যই পাঠান। ভালোবাসা খুবই পবিত্র বিষয়। এটা পবিত্র মানুষদের ভেতর থেকে পবিত্র মানুষের জন্যই বের হয়।’
‘হুম।’
‘হুমায়ূন আহমেদ মানুষটা কিছু কিছু জায়গায় দারুণ বলেছেন। এই যেমন ধরুন, ভালোবাসা হলো কাঁচা সবজির মতো, নষ্ট হয়ে যায়। তাকে বুকের মধ্যে আগলায় রাখতে হয়।’
‘হুম, জানি।’
‘ও আচ্ছা!’
‘মন খারাপ করলেন?’
‘মন খারাপ ভালো, বিষয়টি আপেক্ষিক। নির্ভর করে কার কথায় খারাপ হবে আর কার কথায় হবে না!’
‘আচ্ছা, আপনি এত সুন্দর করে কথা বলেন কীভাবে?’
‘আমার মনে হয় আপনার সময় শেষ। কথা বলে ভালো লাগল। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ!’
উনি আল্লাহ হাফেজ বলামাত্রই আমি দুম করে আকাশ থেকে পড়লাম। ওনাকে আমি চিনি না জানি না, মাত্র তিনটা মিনিট কথা বললাম। এমন কেন মনে হচ্ছে, তাঁকে আমি বহুকাল থেকে চিনি!
এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। তবে অনুমান করে নিয়েছি যে সৃষ্টিকর্তা যাদের সঙ্গে আমাদের মিলন লিখে রাখেন, তাদের চিনে নিতে আমাদের বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন।
এরপর চলে গেছে অনেক বর্ষা-ফাল্গুন, বয়ে গেছে বিভিন্ন ঝোড়ো হাওয়া। তবু শক্ত করে হাতটি ধরে রেখেছে তিন মিনিটের মাথায় কল কেটে দেওয়া মানুষটি।
আজ সেই দিনটির ১০ বছর হয়ে গেল। স্টেশনে বসে শাটলের অপেক্ষায় বসে আছি আর হাসছি। পাশেই বসে আছে নিলয়। হাসি দেখে নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবে, ‘এই কী হয়েছে তোমার? ভয় পাচ্ছ?’ খুবই অদ্ভুত প্রশ্ন করে মানুষটা। ভয় পেলে কেউ হাসে?
‘আচ্ছা, আপনি এত অদ্ভুত কেন?’
‘মায়াবী মেয়েদের নিজের করে পেতে হলে অদ্ভুত হতেই হয়।’
সে সর্বদাই এমন, একটু কবি, একটু রহস্যময়, একটু অদ্ভুত। প্রতিবছর সে আমার আবদার রাখতে সুদূর দিনাজপুর থেকে এখানে এসে তিন মিনিট আমাকে জড়িয়ে ধরে। অনেকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। নানানজনে নানান কথা বলে।
সে বলুক। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এই সময়টা শুধুই আমার। এই সময়টুকু শুধুই আমাদের।
বন্ধু, দিনাজপুর বন্ধুসভা