বলরাম হাড়ি ও লালন: নিপীড়িত মানুষের নেতা

বলরাম হাড়ির মন্দিরছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের মানুষ লালন ফকির ও হাসন রাজার মতো লোকসাধকদের চিনলেও বলরাম হাড়িকে তেমন চেনেন না। তাঁকে না চেনার কারণ হলো, মানুষটি বাস করতেন উনিশ শতকে মেহেরপুর নামক অজপাড়াগাঁয়ের এক দীনহীন অস্পৃশ্য সমাজে। যার জীবনকাহিনিতে বীরত্বের মহিমা নেই, বিত্তবৈভবের জৌলুশ নেই কিংবা অলৌকিকতার জাদু নেই; এমন এক চালচুলোহীন মানুষকে নিয়ে বাঙালি সমাজ মাতামাতি করে না। উনিশ বা বিশ শতকীয় শিক্ষিত বঙ্গসমাজও বলরাম হাড়িকে নিয়ে তেমন আগ্রহ দেখায়নি। লালনের জীবনকাহিনি নিয়ে কবিতা-গান, নাটক-যাত্রাপালা রচিত হলেও বলরাম হাড়িকে নিয়ে উল্লেখ করার মতো কিছুই হয়নি। অথচ তাঁর জীবনকাহিনিতেও নাটকীয়তা ছিল। তাঁকে নিয়েও সিনেমা বা উপন্যাস বানানো যেতে পারত। এই সাধকের নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে মেহেরপুরের শৈলেন হালদার নামক এক মৎস্যজীবী এবং তাঁর দীক্ষাগুরু জামাল ফকিরের মাধ্যমে। বলরাম হাড়িকে তাঁরা প্রাণের ঠাকুর হিসেবে মান্য করেন। গানে গানে আরাধনা করেন। প্রতি সন্ধ্যায় মালোপাড়ার বউ–ঝিরা বলরামের মন্দিরে পূজা দেন, ধূপধুনো জ্বালেন, বলরামের উদ্দেশে প্রণাম জানান। কিন্তু শৈলেনের সাফ উচ্চারণ: ‘ফুলে-জলে দেবতার পূজা হয় না। দীপ-ধূপ-নৈবেদ্য লাগে না পূজার দ্বারে।’

অসাধারণ মানুষ শৈলেন হালদার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিংবা কেতাবি লেখাপড়া না থাকলেও বিভিন্ন সাধকের সান্নিধ্য-সাহচর্য পেয়ে অর্জন করেছেন গভীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। নিজেকে লালন ও বলরামী ভাবাদর্শের একজন নিষ্ঠাবান ভক্ত হিসেবে দাবি করতে ভালোবাসেন। তিনি জাতে শূদ্র, বৃত্তিতে মালো, সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু। কিন্তু দীক্ষা গ্রহণ করেন মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত লালনপন্থী ফকির জামাল শাহের কাছে। জামাল ফকিরও জাতপাত মানেন না।

বলরাম হাড়ির সাক্ষাৎ-শিষ্য বৃন্দাবন হালদারের মৃত্যুর পর (১৯৮৫) মেহেরপুরের জামাল ফকির ও শৈলেন হালদার এবং বারোখাদার বলরামী সজল দাসরাই মূলত বলরামী তত্ত্বের প্রধান ভাষ্যকার ও প্রচারক। বড় বড় ধর্মের দোর্দণ্ড দাপটের মধ্যে তাঁরাই বলরামী মতাদর্শের দীপশিখা জ্বালিয়ে রেখেছেন। আমার নিজের ভেতর প্রশ্ন জাগে, এত ভেদবুদ্ধি, এত জাতপাতের মধ্যে সবাইকে নিয়ে বাঁচার তাগিদ মেহেরপুরের শৈলেন-জামাল ফকির কিংবা কুষ্টিয়ার সজল দাসদের মতো ব্রাত্যজনেরা পেলেন কোথায়? এদের জীবনচর্যার মধ্যে কি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে সত্যিকারের বলরাম হাড়ি ও লালনের মানবিক দর্শনের প্রায়োগিক রূপ? সত্যিই তা–ই। কেতাবের পাতা থেকে পাওয়া বলরাম হাড়ি কিংবা লালন আর পথে পথে ঘুরে বেড়ানো প্রান্তজনের জীবনবেদ থেকে পাওয়া বলরাম-লালনের মধ্যে যে বিস্তর তফাত! কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চবর্গের বুদ্ধিজীবীরা হয়তো এমন এক বলরামের কথা বলবেন, যিনি রামকৃষ্ণদেবের মতো একজন ধর্মসাধক। কিন্তু নিম্নবর্গের জামাল ফকির-শৈলেন হালদাররা বলেন অন্য এক মানবিক বলরাম, ভিন্ন এক মানবিক লালনের কথা। যারা সবার ওপরে মানুষকেই সত্য বলে জেনেছেন। আমরা যারা কেতাবি শিক্ষায় শিক্ষিত, তাঁরা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথের ভিক্টোরীয় রুচির অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে পাতার পর পাতা ভরে একটির পর একটি থিসিস রচনা করে চলেছি। বড় মুখ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্ফুরণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের গৌরবগাথা রচনা করে কত যে শ্লাঘা অনুভব করি, তার হিসাব নেই! অথচ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে গ্রামবাংলার লোকসাধকদের জাতগোত্রহীন মানবিক ভাবনা থেকে উৎসারিত, তা একবারের জন্যও আমরা ভাবতে পারি না। অজপাড়াগাঁয়ের সাধকেরাও যে শত শত বছর ধরে শোষণ-পীড়নের বিরুদ্ধে বঞ্চিত-অধিকারহারা মানুষকে বৃক্ষের মতো জাগিয়ে রেখেছেন, এটা আমরা কোনোভাবেই স্বীকার করতে চাই না। মেহেরপুরের ভৈরবের তীরে জন্ম নেওয়া কোনো এক নিভৃতচারী-নিঃসঙ্গ সাধকও যে আজ থেকে আড়াই শ বছর আগে ব্রিটিশকবলিত, জমিদারতন্ত্রশাসিত সমাজে বাস করে ধর্মান্ধতা, শোষণ, নিপীড়ন ও উচ্চবর্গের অহমিকার বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষকে একাট্টা করতে পারেন; এটা আমরা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারি না!

মেহেরপুরের বলরাম হাড়ির কথা বলছি। আঠারো শতকের শেষের দিকে মেহেরপুরের মালোপাড়ায় জন্ম নেওয়া এক অন্ত্যজ নেতার কথা বলছি। নেতাই বটে! তিনি কোনো সাধক বা সংস্কারক ছিলেন না, মরমি বা মর্মজ্ঞও নন। ছিলেন একেবারেই নিচুতলার মানুষের নেতা। তাঁর সব আবেগ-আকুতি, আচার-আচরণ ছিল গভীরভাবে মানবিক, সর্বতোভাবে ইহজাগতিক। দেব-সাধনার মাধ্যমে পরমার্থিক মুক্তির কথা তিনি কখনো বলেননি, বলতে পছন্দও করতেন না। মাটির মানুষকে ভালোবেসে মানব-ভজনার মাধ্যমে বৈষম্যহীন মানব সমাজ গড়ার সংগ্রামে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, অনুসারীদের ঠেলে দিয়েছিলেন জমিদার-পুরোহিতবিরোধী সংগ্রামের বিস্তৃত ময়দানে। লালনের মতো তিনিও মানুষতত্ত্বের সাধক ছিলেন। জাতিভেদহীন মানবিকতার অস্ত্র নিয়ে তিনি লড়াই করেছিলেন মূর্তিপূজা, ঘটপূজা, শাস্ত্রশাসন ও বৈদিক মন্ত্রের বিরুদ্ধে। তার শিষ্যরাও এ থেকে বিচ্ছিন্ন নন।

বলরামী বা বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের প্রবর্তক বলরাম হাড়ির জন্ম উনিশ শতকের গোড়ায়, আনুমানিক ১৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে অস্পৃশ্য ‘হাড়ি বংশে’। বাবা গোবিন্দ হাড়ি, মা গৌরমণি। সেকালে হাড়িদের জীবিকা ছিল শুয়োর চরানো, গাছগাছড়ার ওষুধ বিক্রি, লাঠিয়ালগিরি কিংবা বড়লোকদের দারোয়ানগিরি। বলরাম ছিলেন মেহেরপুরের বিখ্যাত ধনী পদ্মলোচন মল্লিকের দারোয়ান। নদীয়া জেলার জমিদারদের যেসব পাইক-বরকন্দাজ ও দারোয়ান ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বলরাম ছিলেন বেশ শক্তিশালী-সামর্থ্যবান। তির ছোড়ায় ও লাঠিয়ালগিরিতে ছিলেন অতুলনীয়। জমিদার পদ্মলোচন মল্লিকের বাড়িতে পছন্দমতো কাজ পেয়ে বেশ হেসেখেলে দিন কেটে যাচ্ছিল তাঁর। হঠাৎ এক দমকা হাওয়ায় তাঁর জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। রুদ্ধ হয়ে গেল জীবন-জীবিকার পথ। এক রাতে মল্লিকদের গৃহদেবতার সব অলংকার চুরি হয়ে গেল। সন্দেহ পড়ল বলরামের ওপর। তাঁকে গাছে বেঁধে প্রচণ্ড প্রহার চলল। শেষ পর্যন্ত সবার পরামর্শে গ্রাম থেকে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। এ ঘটনায় জমিদার–বড়লোকদের প্রতি তাঁর ঘৃণা জন্মাল। হয়ে উঠলেন এক প্রতিবাদী মানুষ।

বলরামের জীবনকাহিনি বেশ নাটকীয়তায় ভরপুর, লালনের সঙ্গে খানিকটা মিলও রয়েছে। ব্রাত্য, মন্ত্রবর্জিত, অভিমানী লালন ফকির একদিন ঘর ছেড়ে আমাদের সম্ভ্রান্ত সমাজের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। ভদ্র-অভিজাত সমাজে আর ফিরে আসেননি। যে সমাজ তাঁকে অপাঙ্‌ক্তেয় করে রাখতে চেয়েছিল, সেই সমাজ ছেড়ে বসবাস করেছেন কুষ্টিয়া শহরের বাইরে কালীগঙ্গাতীরবর্তী কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার আখড়ায়। কোনো সম্প্রদায়ের বৃত্তে নিজেকে আটকাতে চাননি; কারণ সব সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে এক স্বপ্নময় রাজ্যে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন। তিনি বক্তৃতা করতেন না, শাস্ত্র পাঠ করে ধর্মের অমৃতকথাও শোনাতেন না। তাঁর একমাত্র সম্বল ছিল গান—কেবলই গান। এই গান দিয়ে তিনি সবাইকে মুগ্ধ করে রাখতেন। লালনের মতো বলরাম হাড়ি গান বাঁধতে জানতেন না। তিনিও লালনের মতো গৃহ ত্যাগ করেন, তবে চিরদিনের জন্য নয়। বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করে তিনি মেহেরপুরে ফিরে এসেছিলেন। তবে জমিদারতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষিত-নিয়ন্ত্রিত ভদ্রসমাজে নয়। তিনি ফিরে আসেন ভিন্ন সাজপোশাকে, ভিন্ন রূপ ও চেহারায়। উচ্চধর্ম ও উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে গড়ে তোলেন বলরামী সম্প্রদায়। সনাতন ধর্মের পরিমণ্ডলের বাইরে ভৈরবের তীরে গড়েন ভিন্নধারার মন্দির। বাউলদের মতো বলরামের অনুসারীরাও শাস্ত্রের প্রাণহীন নিরসতত্ত্ব মেনে নেয়নি। তাঁর অনুসারীরা ছিলেন হাড়ি, ডোম, বাগদি, মুচি, বেদে, নমশূদ্র, মালো এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মুসলমানও। বাংলার সব লোকধর্মে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ কিংবা বৈশ্যদের উপস্থিতি লক্ষ করা গেলেও বলরামী সম্প্রদায়ে উচ্চবর্ণের লোকজন প্রবেশ করতে পারেনি।

বলরামীদের গানে যে মানবিক ভাবনার স্পিরিট পরিস্ফূট হয়েছে তা বৃহত্তর কুষ্টিয়া-যশোরের লালনিক ধারার বাউলদেরও প্রভাবিত করেছে। লালনের মতো বলরাম হাড়ি ও তার অনুসারীরাও জাতিভেদ মানেন না, তাঁরা মানুষভজনে বিশ্বাসী। তাঁরা কেউ গৃহস্থ, কেউ উদাসীন। বলরামীদের আবির্ভাব মূলত শোষিত-বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন প্রতিষ্ঠা ও বাঁচার তাগিদে যেমন তিতুমীরের বিদ্রোহ, বীরসা মুণ্ডার নেতৃত্বে মুণ্ডাদের আন্দোলন, লালনের ফকিরি ধর্ম, হরিচাঁদ ঠাকুরের মতুয়া আন্দোলন, রূপচাঁদ, মনমোহনের আন্দোলনধর্মীয় মোড়কে উপস্থিত হলেও তা ছিল অন্ত্যজ-অস্পৃশ্য, শোষিত, নিগৃহীত ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

ফকির লালন শাহের তিরোধান দিবস উপলক্ষে আখড়াবাড়িতে ভক্ত-অনুরাগীদের ভিড়। কুষ্টিয়া
ছবি: তৌহিদী হাসান

বলরামের অনুসারী ও চ্যালারাও জীবন-জীবিকায় গরিব ক্ষুদ্রচাষি, ভূমিহীন দিনমজুর, অরণ্যচারী, ভবঘুরে ও অচ্ছুত। কিন্তু শুদ্ধ ও নৈতিক জীবনাচরণের দিকে বিশেষ আগ্রহী। সেই সঙ্গে দুর্নিবার, সাহসী ও দুর্বার স্বভাবের। কুষ্টিয়ার বারোখাদা গ্রামের বলরামীরা ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুর এস্টেটের বিস্তৃত জমিদারিতে লেঠেল কিংবা ঠাকুরবাড়ির লেঠেলদের প্রতিদ্বন্দ্বী—লেঠেল ছিলেন ওই হাড়িরামের চ্যালারাই। কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্র কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ ঘাঁটলে ঠাকুরবাড়ির লেঠেল বাহিনীর সঙ্গে প্রজাদের লড়াইয়ের বিবরণ মেলে। ‘...একবার খোদ কুষ্টিয়ায় দেবেন্দ্রনাথ বা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেঠেলদের অত্যাচার থেকে গরিব প্রজাদের বাঁচাতে স্বয়ং লালন ফকির তার দলবল নিয়ে লাঠিসোটা হাতে বেরিয়ে আসেন আশ্রম ছেড়ে।’

রবীন্দ্রনাথের একটি গানে আছে: ‘বৃষ্টিনেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা/ কোন বলরামের আমি চ্যালা’। এই বলরাম কি পৌরাণিক বলরাম? নাকি মেহেরপুরের অন্ত্যজনেতা বলরাম হাড়ি? ‘বলরামের চ্যালা’ শব্দটির সঙ্গে উনিশ শতকের গ্রামবাংলার জনজীবন বেশ পরিচিত ছিল। সে কারণে কবিয়াল কুবির গোঁসাই লিখেছেন: ‘বলরামের চ্যালার মতো/ কৃষ্ণকথা লাগে তেতো।’ রবীন্দ্রনাথ হয়তো কুষ্টিয়ার জুগিয়া-বারোখাদা গ্রামের বলরামের চ্যালাদের দুর্নিবার, দুর্বার ও দুর্দম জীবনের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে এ গান রচনা করেছেন। মেহেরপুরের ভৈরব তীরবর্তী বলরামের মন্দিরের কারুময় উদ্ভাস এবং শৈলেন হালদার, জামাল ফকির ও সজল দাসদের সরল-সহজ মুখ কিংবা মেহেরপুরের মালোপাড়া, নদীয়ার নিশ্চিন্তপুরের বিশ্বাসী ভক্তদের সমাবেশের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কেন তারা বড়লোকদের সমাজ এবং ধর্ম ত্যাগ করেছিল। কেন তারা ডাকাত হয়ে একটি লোকধর্মের সম্প্রদায়ের খেরোখাতায় নাম লিখিয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে, দুই শ বছরের আগে একজন ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী তাদের পরিত্রাণের মন্ত্র এনে দিয়েছেন। রক্তে দিয়েছেন প্রত্যয়। পায়ের তলায় শক্ত মাটি। বেদ–বেদান্ত ব্রাহ্মণশাস্ত্র দলিত–মথিত করে গ্রামে গ্রামে বয়ে দেন গুপ্ত প্লাবন। অথচ তারা দীন–দরিদ্র দুঃখভারানত।

আর পাঁচটা লোকসম্প্রদায়ের সঙ্গে বলরামের চ্যালাদের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তাঁরা এতই দুর্নিবার, বেপরোয়া, উদ্ধত ও যুক্তিনিষ্ঠ যে দেবদ্বিজে, শাস্ত্র-কেতাবে, ভূতপ্রেত, আলাভোলায় মোটেই বিশ্বাসী নন। তাঁদের কারও কারও রক্তে ডাকাতির নেশাও ছিল। অনেকে বড়লোক ব্রাহ্মণদের বাড়িতে ডাকাতি করতেন। কিন্তু কেন ডাকাতি করতেন? অভাব-আকালে নাকি উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য? জমিদার আর বড়লোক ব্রাহ্মণদের অত্যাচারে যাঁরা সমাজচ্যুত হয়ে গ্রামছাড়া হন, তাঁরাই আত্মরক্ষার তাগিদে জঙ্গলাকীর্ণ দুর্গম এলাকা সাফ-সুতরো করে বসতি স্থাপন করেন। তাঁরা সম্ভবত মেহেরপুরের বৃন্দাবন হালদার, জামাল-আরাফাত, শৈলেন হালদার, সজল দাসদের মতো নিচুতলার মানুষের পূর্বপুরুষ। বলরাম হাড়ি একদিন এই নিপীড়িত-অত্যাচারিত, সমাজচ্যুত-অপমানিত মানুষের সামনে তুলে ধরেন বাঁচার এক নতুন মন্ত্র, নতুন চেতনা। তাঁর ও তাঁর চ্যালাদের মধ্যেও ভক্তি-বিনয়-বিশ্বাস ছিল, কিন্তু তাতে ধর্মের দাগ ছিল না। হাড়িরাম মূলত পালন করতে চেয়েছিলেন জাতিভেদহীন মানবতাবাদী সহজ ধর্ম। লালনও তা–ই চেয়েছিলেন। তিনিও অলৌকিকতা ও যুক্তিহীনতায় বিশ্বাস করতেন না। দুই সাধকের মধ্যে খানিকটা পৃথকতা থাকলেও মিল ছিল ঢের বেশি। ফোঁটা-তিলক, টিকি-টুপি তথা বাহ্যিক কায়কর্মের প্রতি লালনের একদম সমীহ ছিল না। ধর্মের নামে আচার-সর্বস্ত্র লোকদেখানো ভড়ংবাজিতেও বিশ্বাস রাখতে পারেননি। লালন দ্বিধাহীন ভাষায় সাফ বলে দিয়েছেন: ‘মাটির ঢিবি কাঠের ছবি/ ভূত ভাবে সব দেবাদেবী/ ভোলে না সে এসব রূপী/ ও যে মানুষ রতন চেনে।।/ জিন ফেরেশতার খেলা/ পেঁচাপেঁচি আলাভোলা/ তার নয়ন হয় না ভোলা/ ও যে মানুষ ভজে দিব্যজ্ঞানে।’

মেহেরপুরের বলরাম হাড়ি ও লালন দুজনেই ছিলেন মানবতাবাদী সাধক। দুজনের ধর্মমতের সারকথা অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবিক অধ্যাত্মবাদ। দুজনেই মানুষকে ভালোবেসে মানুষের জন্য কখনো গান গেয়েছেন, কখনো লাঠিয়ালগিরি করেছেন। নির্ভীকচিত্তে মানবতার জয়গান গেয়েছেন। দুজনেই ছিলেন হিন্দু–মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায় এবং ধর্মের মিলনসাধক। ধর্মীয় ভেদবুদ্ধি তাঁদের স্পর্শ করতে পারেনি। বয়সের হেরফের থাকলেও বলরাম হাড়ি (১৮২৫-১৮৯০) ও লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) একই সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলার জল-হাওয়ায় পরিপুষ্ট হয়েছেন, দুজনের চিন্তার মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট সাদৃশ্য ও সমরূপতা। তাহলে কি দুই মানবভজনিয়ার মধ্যে কোনো মনোজাগতিক যোগাযোগ ছিল? তাঁরা কি পরস্পরকে চিনতেন!

সভাপতি, মেহেরপুর বন্ধুসভা ও সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ