অপরাহ্ণের গল্প

মডেল: সুমন ও দিবাছবি: আরিফুল হক

বইমেলা চলছে। অনিমরা কয়েকজন মিলে হাঁটছে মেলার মধ্যে। বইয়ের প্রতি অনিমের কোনো আকর্ষণ নেই। বইবিমুখ প্রজাতির মানুষ সে। লেখক, কবিরা তাঁর কাছে উদ্ভট চরিত্র। তাঁর দৃষ্টিতে এরা মানুষের আবেগ নিয়ে খেলে। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে অনেকটা মনের ভুলেই মেলার দিকে পা বাড়ায়। অবশ্য বই কেনার নেশা কারও নেই। ঘুরেফিরে সুন্দরী তরুণীদের দেখাই মুখ্য উদ্দেশ্য। সহজ করে বললে বাউন্ডুলে। যেখানে মেয়ে আছে, সেখানে একটু ভাব জমানোর চেষ্টা। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে দেখে। অযথাই দাম জিজ্ঞেস করে। সুবিধা করতে না পেরে কালক্ষেপণ করে চলে আসে। অন্য জায়গায় গিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অনিমের এসবের প্রতি খুব একটা আগ্রহ নেই। প্রথম থেকেই একটু দূরত্ব রেখে চলছে।

মানুষের ভিড় থেকে সরে এসে একটা ফাঁকা স্থানে দাঁড়িয়ে হঠাৎ দূরের একটা স্টলের দিকে চোখ আটকায় অনিমের। জনা তিনেকের ছোটখাটো জটলা। সাদা শাড়ি পরিহিতা এক সুন্দরী তরুণী বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছে। মুখে নির্মল হাসি রেখে বই তুলে দিচ্ছে হাতে। দৃশ্যটা দেখতে অনিমের ভালো লাগছে। মূলত মেয়েটাকে ভালো লাগছে। অনেকটা আনমনেই স্টলের দিকে এগিয়ে যায় সে। একেবারে মেয়েটার সামনাসামনি। অন্যদের ততক্ষণে বই নেওয়া শেষ। সামনে থেকে অনিম একটা বই হাতে তুলে নেয়। নামটা দেখে বইয়ের। ‘অটোগ্রাফ লাগবে? আপনার নামটা বলুন।’ বই হাতে নিতে নিতে মেয়েটা অনিমকে জিজ্ঞেস করে। কিছুটা ঘোরের মধ্যে থেকেই জবাব দেয়, ‘অনিম’।
হাতের কলম দিয়ে খসখস করে মেয়েটা দুটো লাইন লিখে দেয় নতুন বইয়ের ওপর। অনিম তাকিয়ে থাকে লেখিকার মুখের দিকে। টাকা দিতে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে মনে পড়ে, মানিব্যাগ ভুল করে বাসায় রেখে এসেছে। আশপাশে বন্ধুদেরও দেখা যাচ্ছে না। কিছুটা লজ্জিত এবং বিব্রত হয়ে বলে, ‘লিখে ফেলেছেন? ভুল করে মানিব্যাগটা ফেলে এসেছি। আমি কাল এসে নিয়ে যাই?’

মেয়েটা এবার চোখ তুলে তার মুখের দিকে তাকায়। এমন ঘটনা জীবনে প্রথমবার ঘটেছে। ‘ঢাকায় থাকেন?’ অনিমকে জিজ্ঞেস করে। ‘এই তো সামনে, হলেই থাকি’ জবাব দেয় সে। একটু ভেবে বইটা অনিমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা তাহলে তো কাছেই থাকেন। বইটা নিয়ে যান। একসময় এসে টাকাটা দিয়ে যাবেন। আমি বলে রাখছি।’ অন্য একজন আসায় মেয়েটা আবার বইয়ে ডুব দেয়। সে চুপচাপ বই নিয়ে স্টল ছাড়ে।

অন্যদের সঙ্গে সামনে বের হওয়ার পথে দেখা। হাতে বই দেখে একটু অবাকই হয়েছে সবাই। বইয়ের ঘটনা জানতে চায়। বইটা হাতে নিয়ে দেখতে চায়। কিন্তু অনিম সুযোগ দেয় না। সবাইকে নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায়। টিএসসিতে একটা টঙের সামনে দাঁড়িয়ে চায়ের আড্ডায় মাতে বন্ধুদের সঙ্গে। রাতে এসে মনে হয় বইটা ফেলে এসেছে দোকানে। এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না। সে ভাবে অন্য কিছু। যেখানে বইয়ের স্রষ্টাতে মজে আছে, সেখানে বই নিয়ে ভেবে কী করবে।

বইমেলার দিকেই যাচ্ছিল তানিয়া। অনিমের ফেলে যাওয়া বইটা দোকানের একপাশে রাখা ছিল। তানিয়ার নজর সহজেই সেদিকে গেল। নিজের বই। একবার দেখেই চিনে ফেলে। বেঞ্চিতে বসে চায়ের অর্ডার দিয়ে দোকানিকে জিজ্ঞেস করে, ‘বইটা কার?’ ছেলেটা জবাব দিল, ‘একজন ফেলে রেখে গেছে দুই দিন আগে। নেওয়ার আর খবর নেই।’ সে বইটা খুলে দেখে তাঁরই অটোগ্রাফ দেওয়া। পরে সেদিন বিকেলের ঘটনাটা মনে পড়ল। দোকানের ছেলেটাকে বলল, ‘বইটা আমার পরিচিত একজনের। আমি নিয়ে যাই। দেখা হলে দিয়ে দেব।’ সে মাথা নেড়ে সায় দেয়, ‘দিয় দিয়েন। দুই দিন ধইরা খামাখা পইড়া আছে।’ তানিয়া বইটা হাতে নিয়ে মেলার দিকে পা বাড়ায়।

আজ সন্ধ্যার পর আবার এসেছে অনিম। একা একাই এসেছে আজ। বইয়ের টাকা দেওয়াটা একটা বাহানামাত্র। লেখিকার সঙ্গে আরেকবার দেখা হয়ে যাওয়ার লোভেই এসেছে। আজ স্টলের সামনেই সেই মানবী দাঁড়িয়ে আছে। ‘কেমন আছেন?’ জিজ্ঞেস করে অনিম। তানিয়া মুচকি হেসে নিচু স্বরে জবাব দেয়, ‘ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’ ‘হ্যাঁ। সেদিনের টাকাটা দিতে এলাম। আজ আরেকটা বই লাগবে বন্ধুর জন্য। তার জন্মদিনে উপহার দেব।’

‘বই পড়ে আপনার কেমন লেগেছে?’ ‘অসম্ভব সুন্দর। অনেক ভালো লেখেন আপনি। নাহলে কি আবার বই নিতাম!’ তানিয়া এবার কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকায় অনিমের মুখের দিকে। সে দেখছে একটা বড় মিথ্যা কীভাবে অনায়াসে ছেলেটার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। সে আর কিছু বলে না। বন্ধুর নাম জিজ্ঞেস করে অটোগ্রাফ দিয়ে দেয় বইয়ে।

‘আর হ্যাঁ, শুধু আজকের বইয়ের টাকাটা দিলেই হবে। সেদিনেরটা আপনার জন্য উপহার।’ কাজ শেষ হলে বইটা নিয়ে বাইরের দিকে পা বাড়ায় অনিম। দূর থেকে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করলেও সে চায় একেবারে কাছ থেকে দেখতে। তা ছাড়া লুকোচুরি ব্যাপারটাও পছন্দের না। অনিমের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে তানিয়া। তার লেখক মনে এবার নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়। স্টলের ভেতর বসে বসে ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করে। সব সুতো একসঙ্গে মেলাতে পারে না।

দিন তিনেক পর আবার আগমন ঘটে অনিমের। কিন্তু স্টলে মানুষটিকে দেখতে না পেয়ে মাঝপথ থেকে হতাশা নিয়েই ফিরে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাস্তায় দেখা তখন। ‘আপনি?’ ‘হ্যাঁ, আপনার কাছেই এসেছিলাম। আরেকটা বই লাগবে। ছোট বোন আবদার ধরেছে, বইমেলা থেকে নতুন বই চায়। ভাবলাম আপনার বইটাই দিই।’ তানিয়া মুচকি হাসে। তারপর কপাল কুঁচকে উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা। বই তো স্টলেই ছিল। নিয়ে গেলেই পারতেন।’ ‘লেখিকার কাছ থেকে নেওয়া আর দোকান থেকে নেওয়া কি এক হলো? বোনকে বলতে পারব, লেখিকার অটোগ্রাফসহ এনেছি।’ তানিয়া কিছুটা লজ্জা পায়। লাজুক হাসি টানে ঠোঁটে। অনিমের চোখ এড়ায় না।

আজ তানিয়ার স্টলের সামনে খুব বেশি জনসমাগম নেই। ছুটির দিনে ভিড় থাকলেও অন্যান্য দিনের মতো ম্যাড়মেড়ে। তা ছাড়া তার মতো নতুনদের জন্য তো আরও ম্যাড়মেড়ে। একা বসে বসে সময় কাটাচ্ছে। মানুষের চলাফেরা দেখছে। ভালোই লাগছে। ‘লেখিকা কি গল্প খুঁজছেন? নতুন কিছু পেলেন তবে?’ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল অনিম। কিছুটা চমকেই গিয়েছিল তানিয়া। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, অনিম দাঁড়িয়ে। ‘আপনি এখানে! আজ কার জন্য বই লাগবে?’ জিজ্ঞেস করে সে। ‘আজকে কারও জন্য লাগবে না। এমনিতেই ঘুরতে এসেছিলাম। আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।’

অনিমের বাহানা এবার তানিয়া ধরতে পেরেছে মোটামুটি। যে লিখতে জানে, সে মানুষের মন পড়তে পারবে না, এমনটা খুব কমই হয়। আরেকটু পরীক্ষা করার জন্য গল্পের ফাঁদ পাতে। আমার বইয়ের কোন চরিত্রটা বেশি ভালো লেগেছে, ইরা নাকি অন্তরা? অনিম এবার একটু আটকে যায়। সে বইয়ের পাতা খুলেও দেখেনি। চরিত্র নিয়ে জানবে কীভাবে? তবু সেটা তো বুঝতে দেওয়া যাবে না। সে দুজনকে দুই দিক থেকে ভালো লেগেছে বলে উত্তর দেয়। মানুষ নিয়ে নানা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে বাসার দিকে পা বাড়ায়। আজ প্রথমবার এতক্ষণ কথা হয়েছে। মনটা অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে উঠেছে অনিমের।

পরদিন সন্ধ্যার পরপরই আবার হাজির। হাতে একটা ছোটখাটো বইয়ের তালিকা। এক বইপোকা বন্ধুর থেকে ছিনিয়ে এনেছে বলতে গেলে। সে নিজেই এসে কিনতে চাইছিল কিন্তু অনিম জোর করে তালিকাটা নিয়ে দায়িত্বটা নিজের ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। বেচারা নিজেও অবাক হয়েছে ব্যাপারটায়। তানিয়া স্টলের সামনেই পায়চারি করছিল। অনিমকে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী ব্যাপার অনিম সাহেব?’ অনিম তালিকাটা দেখিয়ে হাসিমুখে জবাব দিল, ‘কিছু বই কিনতে এসেছিলাম। ভাবলাম আপনাদের এখান থেকেই নিয়ে যাই।’ তানিয়া হাত বাড়িয়ে তালিকাটা দেখতে চায়। অনিম সেটা হাতে দেয়। তালিকা দেখে তানিয়া বলে, ‘আমাদের কাছে বইগুলো নেই। ঘুরে ঘুরে, দেখে দেখে কিনতে হবে। এক জায়গায় সব কটা পাবেন না। চলুন আমিও কিছু বই কিনব, একসঙ্গেই কিনি।’ তানিয়া বলল। এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। এটাই তো চাচ্ছিল অনিম। সম্ভাব্য স্টলগুলোয় গিয়ে ঢুঁ মারছে তাঁরা। নিজেদের বইগুলো খুঁজছে।

দুজন একসঙ্গে চষে বেড়াচ্ছে পুরো মেলা প্রাঙ্গণ। ছুটে যাচ্ছে এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। বই খোঁজার ফাঁকে একসঙ্গে থাকার আরও অনেকটা সময় পেয়ে গেছে অনিম। ব্যাপারটা ভালো লাগছে খুব। সে চাচ্ছে, সময়টা যেন না ফুরায়। বন্ধুকে গালাগাল দিচ্ছে মনে মনে, তালিকাটা কেন আরও বড় বানাল না!

এক পিচ্চি ফুল নিয়ে এসে কেনার জন্য তাদের কাছে বায়না ধরে। অনিম অনুমতি চায় তানিয়ার। সে সায় দেয়। অনিমের কাছ থেকে ফুলটা নিয়ে কানে গুঁজে দেয়। তাঁকে দেখে অনিমের হৃদয়ে বয়ে যাচ্ছে টিনেজ প্রেমের নদী। উথাল–পাতাল করা প্রেম। তবে যখন তানিয়া তাকে নিয়ে বের হওয়ার রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট খুপরি দোকানগুলোয় ঢুঁ মারে, তখন নিজেকে একটু অসহায় লাগে। অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। জীবনে কখনো এসব দোকানের সামনে সে যায়নি। কার জন্যই বা যাবে! কেনাকাটা শেষে বাঁশিওয়ালার মোহনীয় বাঁশির সুরে সন্ধ্যারাতটা বেশ ভালো কাটে তানিয়ার। টের পায়, তার লেখা বইয়ের একটা জীবন্ত চরিত্রকে যেন সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে সে। যেমনটা সে চায়, যাকে সে চায়।
ঘড়ির কাঁটায় ৯টা পার হতে চলল। দুজনের ফেরার পালা এবার।

‘অনিম সাহেব, দাঁড়ান। এভাবে আর কত দিন? আমাদের কি প্রেম করা উচিত? নাকি এভাবেই প্রতিদিন বই কিনে কিনে আপনাকে ফতুর বানিয়ে দেওয়া উচিত? আর হ্যাঁ, বইটা তো নিয়ে যান। আবার দেখা হবে।’

অনিম লাজুক হেসে মাথা চুলকায়। লেখকের গল্পের এখানে ইতি হলেও তাদের দুজনের গল্পের শুরু।

সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা