একজন হার না মানা যোদ্ধা মায়ের গল্প ‘কখনো আমার মাকে’

আনিসুল হকের উপন্যাস ‘কখনো আমার মাকে’ছবি: সংগৃহীত

সদ্য স্বাধীন দেশে সত্তর-আশির দশকে মফস্‌সলে বসবাস করা একটি পরিবার। একদম গ্রামীণ আবহে দুই মা, বাবা আর চার ভাইবোনের যৌথ সংসারে বসবাসের অতি সাধারণ ঘটনাবলির সাবলীল বর্ণনা দিয়ে গল্পের শুরু হলেও একজন সংগ্রামী মায়ের জীবনের রহস্য উন্মোচনের মধ্য দিয়ে ঘটে সমাপ্তি। বড় মায়ের কোমলতা আর ছোট মায়ের কঠোরতার সংমিশ্রণে সন্তানদের জীবনে সফলতার গল্প যেমন আছে, তেমনি আছে পরিবারের সমৃদ্ধি আনয়নে বড় ভাইয়ের, পরিবারের বড় সন্তানের আত্মত্যাগের গল্প। আছে অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার জন্য একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ় প্রত্যয়ের গল্প। আছে স্নেহ–শাসনে বেড়ে ওঠা ভাইবোনদের শৈশব-কৈশোরের গল্প।

‘কখনো আমার মাকে’ শিরোনামে শামসুর রাহমানের একটি কবিতা আছে। যেখানে পড়েছিলাম,
‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’
আনিসুল হকের উপন্যাসে ছোট মা শেফালী যেন সেই চরিত্রেরই প্রতিবিম্ব। কিন্তু কেন? বড় মা তো এমন নয়। তাহলে ছোট মা কেন একেবারে উল্টো স্বভাবের। প্রশ্নের উত্তর মিলবে কাহিনির একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে। যা মুহূর্তেই পাঠকহৃদয়ে শিহরণ সৃষ্টি করে।

‘কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।
সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে
আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।’

ফুলপুর পাইলট হাইস্কুলের বর্ণনা দিয়ে উপন্যাসের শুরু। যে মাঠটা তাদের কাছে তেপান্তরের মাঠ। এরপর বড় ভাইয়ের ছোট ভাইকে হাবলু প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা। এই চেষ্টায় সফলতাও মেলে। শেওলা জমা সার্কেল অফিসের চুন-সুরকির দালানে দোতলায় বসবাস। বাড়ির পেছনে ইঁদারা। ইঁদারায় সাঁতারকাটা শিং মাছগুলোকে তারা জিন মনে করত। এক্কাদোক্কা খেলা কিংবা সিগারেটের প্যাকেট ছিঁড়ে মোটা কাগজের টুকরোকে উপকরণ বানিয়ে তাস খেলা। দুধ দেওয়া সাদা গরু হারিয়ে গেলে গরু খুঁজতে যাওয়ার পর দুই ভাই–বোনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর কিছু ঘটনা, সাপ–বেজির ভয়ংকর খেলা। আতাফল পেরে নিয়ে আসার সময়টায় অন্ধকারে দিগ্‌বিদিক ছুটতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া, অতঃপর আতিয়ার মামার দর্শন যেন একটা শ্বাসরুদ্ধকর মুহূর্তের পরেই স্বস্তি। এ যেন সে সময়কার মফস্‌সলে বসবাসকারী বাংলার প্রতিটি পরিবারের প্রতিচ্ছবি।

আমাদের ২০০০ সালের আগে যাদের জন্ম, তারা ছেলেবেলায় এ ব্যাপারগুলো কিছুটা হলেও পেয়েছি বলে হয়তো উপলব্ধি করতে পারি। আতিয়ার মামা শুধু গরু নয়, বাড়ির ছেলেমেয়েরও দেখাশোনা করত। ঠিক যেমনটি নিজের ছোটবেলায় এক মামাতো ভাইসহ আমরা আমাদের ইয়াকুব মামার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ঘটনাটি পড়তে গিয়ে সেই স্মৃতি যেন রোমন্থিত হচ্ছিল বারবার।

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক রংপুর অঞ্চলের মানুষ। নীলফামারীর সন্তান। আমার নিজেরও বেড়ে ওঠা রংপুরের আরেক জেলা কুড়িগ্রামে। এ জন্য হয়তো এত চেনা কথা, এত চেনা ভাষা, এত চেনা ঘটনাবলি—যেগুলো শৈশব–কৈশোরের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বারবার। বুড়ির কাছে দাঁতের পোকা ফেলানো থেকে শুরু করে কানশিকার গাছকে মধুগাছ বলা। কানশিকার সাদা ফুল ছিঁড়ে বোঁটাছাড়া করে চুষে চুষে মধু খাওয়া। মায়ের কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া। ভোরবেলা কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা, পাখিদের গান শোনা, টিউবওয়েলের হাতল বুকে ঠেলে পানি বের করা, বাবার বলা সেই প্রচলিত কৌতুক, স্টোররুমের চালের বস্তায় আতাফল পাকিয়ে খাওয়া, বৃষ্টিতে ভেজা, কী নেই এখানে! আছে হুট করে এত বছর পর বড় মায়ের সন্তানসম্ভবা হওয়ার পরে বড় ছেলে বাবলুর লজ্জা পাওয়ার অনুভূতির কথা। এই বাবলু ভাই পরে ছোটলুকে সবচেয়ে বেশি আদর করত।

একজন হার না মানা যোদ্ধা মায়ের গল্প ‘কখনো আমার মাকে’
ছবি: সংগৃহীত

বাবা চরিত্রে বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুর রহমান একজন সরকারি কর্মকর্তা। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার দৃঢ়চেতা স্বভাবের কারণে মিথ্যা মামলায় ফেঁসে গিয়ে জেলে থাকতে হয় এক রাত। অতঃপর চাকরি থেকে সাসপেন্ড। এ ঘটনার কারণে হয়তো হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। এর মধ্যে কাশেম মামার আগমন। বড় ভাই বাবলু যে তাদের বাবার সন্তান নয়, সম্পত্তির উত্তরাধিকারী নয়, সে বিষয়ে বাকিদের কান ভাঙানোর চেষ্টা চলে। যদিও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পরবর্তী সময়ে সেই বাবলু ভাই কাঁধে তুলে নেয় পুরো পরিবারের দায়িত্ব। ক্লাসের ফার্স্ট বয় ঢাকায় গিয়ে একটা অফিসে চাকরি নেয়। মাসের শেষে বাড়িতে টাকা পাঠায়। বাকিরা তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যায়। একে একে প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়। বড় মা না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। ছোট মা বাড়িতেই একা থেকে যায়। বাবার কবর যে সেখানে রয়েছে।

হঠাৎ একদিন ছোট মা অসুস্থ হলে তাকে ঢাকায় নেওয়া হয়। পিজি হাসপাতালে। গলায় ক্যানসার ধরা পড়ে। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা সংকটাপন্ন। সে বাবলু, লাভলি, ছোটলুসহ সবাইকে একখানে করতে বলে। কথা বলতে কষ্ট হলেও একে একে বলতে থাকে আর রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে। কেন তাদের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। কেন দ্বিতীয় বিয়েতে অনুমতি থাকা সত্ত্বেও তাদের বাবাকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল। কেন কাশেম মামা তাদের কান ভাঙানোর সুযোগ পেয়েছিল। কেন তাদের মা কখনো গান গায় নাই, হাসে নাই, কাঁদে নাই। এত শক্ত, এত শক্তি তাদের মা কোথায় পেয়েছিল। যেন শ্রদ্ধায় অবনত হয় চিত্ত। অতঃপর মায়ের মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘তোমরা সাক্ষী থেকো, আমি আমার যতটুকু করার করে গেছি। আমার যুদ্ধে আমি হারিনি...’

এ যেন একজন হার না মানা যোদ্ধা মায়ের গল্প। আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাসটির মতো এটিও তুমুল পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে বলে বিশ্বাস।

রাজারহাট, কুড়িগ্রাম