২০০১ সালের কথা; কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন। থাকতাম নজরুল হলের ৩০৯ নম্বর কক্ষে। সে সময় হুমায়ুন কবির স্যারের ক্লাস মানে ছাত্রদের কাছে কুমিল্লার রসমলাই। স্যার আমাদের হিসাববিজ্ঞান ক্লাস নিতেন। হিসাববিজ্ঞান রসকষহীন বিষয়, হুমায়ুন স্যার পাঠদানের সময় রস দিয়ে টইটম্বুর করে কঠিন সমাধানগুলো সহজ করে বোঝাতেন। তিনি আমাকে মজা করে বলতেন, ‘চট্টল এক্সপ্রেস এনাম কাতায় টুকলে হবে না মাথায়ও টুকে নিয়ো।’
হুমায়ুন কবির ভূঁঞা স্যারের জন্ম কুমিল্লা জেলার দেবীদ্বার থানার ভিংলাবাড়ী গ্রামে। বাবা আলহাজ মো. হোসেন ভূঁঞা, মাতা আনোয়ারা খাতুন। ওনার পড়ালেখার হাতেখড়ি ভিংলাবাড়ী গ্রামে। কোম্পানীগঞ্জ বদিউল আলম উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি, দেবীদ্বার ক্যাপ্টেন সুজাত আলী সরকারি কলেজ থেকে ১৯৮১ সালে প্রথম বিভাগে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৪-৮৫ সালে হিসাববিজ্ঞানে সম্মান ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। নবম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে (হিসাববিজ্ঞান) নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে বরগুনা সরকারি কলেজ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করেন।
হুমায়ুন স্যারকে দেখতাম কখনো গুরুগম্ভীর, কখনো রসিক। তিনি সদা বিনয়ী, হাস্যোজ্জ্বল, সদালাপী, নিরহংকার সাদা মনের একজন মানুষ। দীপ্তিমান এই ব্যক্তির কাছে জ্ঞান এবং অদম্য ইচ্ছাশক্তি—দুটিই ছিল। স্যার ছিলেন বহু ছাত্রের দিকপাল জ্যোতির্ময় এক প্রাণবন্ত শিক্ষক, যাঁর আলোতে অনেকের জীবনের চূড়ান্ত হিসাব পরিবর্তন হয়েছিল। এ জন্যই বোধ হয় মালালা ইউসুফজাই বলেছিলেন, ‘আমাদের মনে রাখতে হবে একটি বই, একটি কলম ও একটি শিশু এবং একজন শিক্ষক বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারে।’
একদিন কয়েকজন বন্ধু মিলে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য গেলাম। স্যার বললেন, ব্যাচে কিন্তু জোড়া থাকতে হবে। জোড়া মানে আবার কবুতর পাখির জোড়া মনে কোরো না। চারজন ছেলের সঙ্গে চারজন মেয়ে থাকতে হবে, না হলে রেওয়ামিল—চূড়ান্ত হিসাব মেলাতে পারবে না। সবাই হেসে উঠলাম। পরে মৌ, মেরী, লাভলী, সুমা, সালাহউদ্দিন, জিয়া, আলিমসহ আটজনের একটি ব্যাচ করলাম। স্যার বললেন, তোমরা জানো আমার ৩২ জোড়া কাপল আছে, যারা হিসাববিজ্ঞান পড়তে এসে ইশক-ভিশক বিয়ে করছে। তবে সবাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে বিয়ে করেছে কিন্তু।
তিনি সপ্তাহে তিন দিন প্রাইভেট পড়াতেন। বাসা ছিল বাগিচাগাঁও। একদিন দেরি হয়েছিল, স্যার বললেন, ‘কী রে চট্টলা এক্সপ্রেস, দেরি হলো কেন? ফয়জুন্নেছা হলের সামনে নাকি মহিলা কলেজের সামনে কারও জন্য অপেক্ষায় ছিলা? দুটি জুটি আসেনি। প্রেমতলায় গেছে মনে হয়!’ সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ।
স্যার হেসে বললেন, ‘প্রফিটের বিপরীতে যদি লস হয়, দেখবা গার্ল ফ্রেন্ড আরেকজনে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। তখন তালা নিয়ে রাস্তায় নেমে গলা ছেড়ে গাইবে “দিনের নবী মোস্তফা রাস্তায় দিয়া হেঁটে যায়, বাকি একখান পয়সা ছিল গাছের তলায়”। ১ টাকা হলো কিন্তু অ্যাকাউন্টিং; ১ টাকা জীবন, ১ টাকাই বাস্তবতা। সিনেমায় দেখনি ১ টাকায় কাবিন হয়।’ স্যারের কাছে পড়ার সময় হিসাববিজ্ঞানকে মনে হতো দুধ-ভাত। একদিন জানলাম হুমায়ুন স্যার চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কলেজে বদলি হয়েছেন। তাঁকে কলেজে দেখতে গেলাম। আমাকে দেখে বিস্মিত হলেন। স্যারকে বাড়িতে দাওয়াত করেছিলাম। আহা কি আনন্দ! হিসাববিজ্ঞানের কিংবদন্তি বাড়িতে। কখন যে পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে ফিরেছি টেরও পাইনি।
২১ বছর পর স্যারকে দেখতে বন্ধু আলীমসহ ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়েছিলাম। পা ছুঁয়ে সালাম করতেই তিনি আমাদের বুকে জড়িয়ে নিলেন। কত দিন পর স্যারের সঙ্গে দেখা।
২০২১ সালে স্যার অবসর নিয়েছেন। ওনার তিন ছেলে। বড় ছেলে শাদমান সিএ সম্পন্ন করেছেন, মেজ ছেলে ইশমাম সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়ায় রাষ্ট্রপতি পদক পেয়েছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক পিতার জন্য এর চেয়ে বড় সম্মান প্রাপ্তি কি হতে পারে জানা নেই। ছোট ছেলে তাহিয়াত ইন্টারমিডিয়েটে অধ্যয়ন করছে। আড্ডার ফাঁকে স্যারের স্ত্রী জেসমিন ম্যাম মজার ভোজনরসদ নিয়ে হাজির।
গোধূলিবেলায় যখন স্যারের বাসা থেকে ফিরছিলাম, তিনি বললেন, ‘তোদের বাসে তুলে দিয়ে আসব। রাস্তা চিনবে না।’ স্যার আমাদেরকে বাসস্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। বাস না ছাড়া পর্যন্ত স্টেশনে দাঁড়িয়ে রইলেন। সত্যিকারের অভিভাবক শিক্ষাগুরুরা বুঝি এমনই হয়। এ জন্য বলা হয় শিক্ষকেরা হলেন দ্বিতীয় জন্মদাতা। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সব সময় স্যারের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
পটিয়া, চট্টগ্রাম