আকাশখামে পত্র দিয়ো
একই বৃত্তকে কেন্দ্র করে অসীম পথচলায় একই নগরের ধূলিকণা পদতলে করছে আর্তনাদ। অথচ দেখো, ধরাছোঁয়ার ত্রিসীমানার বাইরে কতটা আলোকবর্ষ তোমার–আমার মধ্যকার দূরত্বের ব্যবধান। সেদিনের পর ঠোঁটচেপে লুকোচুরি খেলতে শিখেছি হিমালয়সম দুঃখমালাদের তীব্রতাকে নিজের করে বুকপাঁজরে আগলে রেখে। আজও ওরা নির্বাক শ্রোতা হয়ে শ্রবণ করছে সব কটা অশ্রুজলের তরঙ্গকে।
তারপর, আমাদের আর হয়নি গোপন যোগাযোগ, হতে হয়নি হাঁটতে হাঁটতে মুখোমুখি অপ্রস্তুত হওয়া হঠাৎ দেখা। কোনোকিছু উথালপাতাল লাগেনি, হয়নি থমকে যাওয়া। হলদে খামে ভর করেনি খুদে বার্তা ঠিকানাবিহীন ডাকঘরে। কোনো ডাকপিওনের সাইকেল চেপে আনা প্রাপকের চিঠির জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষায় কাটেনি দ্বিপ্রহর। চিঠিরা পায়নি কোনো ডাকনাম, নাহয় সম্বোধন শব্দ।
ফুলগুলো শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে নামচায় ভীষণ অযত্নে-অবহেলায়। মেঘেরা ঘোলাটে হয়ে গেছে সেদিনের পর থেকে, আজ ওরা ছড়িয়ে–ছিটিয়ে যেতে চায় আকাশজুড়ে। মোমবাতির সদ্যগলা মোম কিংবা হারিকেনের উত্তপ্ত গ্লাসের মতন অনুভূতিরা আঁচড় কাটে নিউরনে নিউরনে। কালিদের হাহাকার আর মন কাঁদায়নি বাক্যব্যয়ের বিয়োগ ব্যথায়। ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটের পরে থাকা ফিল্টারের মতন অবহেলিত সেরিব্রামের রংচটা স্মৃতি-বিস্মৃতি। অ্যাসট্রের ছাইগুলো হাতছানি দেয় অভিমানী বালিকার ভেজাচোখের অশ্রুর মতন বারিধারাকে। ভিজে যেতে চায় তারা ভীষণ রকম, যেমন ভিজতে চায় এই চঞ্চল তৃষ্ণার্ত শুষ্ক আঙুল ঘোর শ্রাবণের সঙ্গে সন্ধিক্ষণে।
আমাকে চাঁদ পায়নি, পায়নি ক্ষয়ে যাওয়া জোছনা মাঝরাতে তার মন খারাপের সময়, যখন সারাটা আকাশের মেঘপুঞ্জ অভিমানে কালো হয়ে এসেছিল। তোমার মনের আকাশে আকাশ পাঠিয়েছিলাম, অথচ তুমি আকাশের বিশালতার মধ্যে দাঁড়িয়ে বোঝার ভান করলে সবই, যদিও তুমি বোঝোনি কিছুই। তুমি নরকের বহ্নি চেন? চেন নির্ঝরের ভঙ্গুর স্বপ্ন, পাথরচাপা নগরপথ, শহরতলির অলিগলি, দমকা হাওয়ার ধ্বনি, তপ্ত বারুদের গন্ধ, ভেজা মাটির গন্ধ, অশ্রুগড়া শব্দ, ছেঁড়াপাতার আর্তচিৎকার? কিছুই চেন না তুমি, অথচ সব চেনার-জানার-বোঝার ভান করেছিলে। তবে কীভাবে চিনবে আমাকে?
তুমি জানো পিনপতন নিঃস্তব্ধতায় আমার বিষাদসিন্ধুর ঢেউ গুনেছি কতগুলো ঘুমছাড়া রজনী? বিষাদসিন্ধুর লাবণ্য সাক্ষী, সাক্ষী তার জোয়ার, কতটা পাহাড়সমান বিষাদদের বহন করে আসছে কাল থেকে কালান্তরে। আমি নবপ্রভাতের দূর্বাঘাসে কুহেলিকায় দেখেছিলাম তোমার রহস্যময় প্রতিবিম্ব। তাই তো, কুহেলিকায় মাথা এলিয়ে দিলে চোখ জুড়িয়ে যেত গভীর নিদ্রায়। আকাশের নিচে পরে থাকত এই নিথর দেহ। একগুচ্ছ কদম হাতে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে অপেক্ষা করেছি শ্রাবণের পর শ্রাবণ। চোখ ঘোলাটে হয়ে গেছে কতটা, অশ্রু লুকিয়েছিল বৃষ্টির পানিতে। তোমার সঙ্গে হাতে কদম নিয়ে ভেজার কথা ছিল, কিন্তু তুমি এলে না। কদম ঝরে গেল অভিমানে-অভিযোগে।
আজও খুব করে জানতে ইচ্ছা করে, কেমন আছ? মন খারাপে আসে না তো চোখে জল? না, না, মন খারাপ করতে নেই, মনে রেখো। দোয়া করি অনেক ভালো থেকো। হাসিমুখটা যেন কখনো ম্লান না হয়। আমি হাসিমুখ নাইবা দেখলাম, নাইবা মনে রাখলাম, তাতে কিছু যায়–আসে না। তুমি শুধু সুখে থেকো, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকো না কেন!
অবকাশে বিষণ্নতায় আকাশখামে পত্র দিয়ো। পেয়ে যাবে তার প্রত্যুত্তর।
বন্ধু, জামালপুর বন্ধুসভা