খান আতাউর রহমান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বিরল মানুষ। এই চলচ্চিত্রটির কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার, সুরকার এবং একটি চরিত্র, বাঁধনের বাবা হয়ে অভিনয়ও করেছেন তিনি।
‘এখনো অনেক রাত’ নামটার মধ্যেই অসীম ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে। ২৫ মার্চের কালরাতে অগণিত ছাত্র–শিক্ষক–বুদ্ধিজীবী সাধারণ মানুষের হত্যার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনারা ভয়ংকর রাত নামিয়ে এনেছিল। এরপর ৯ মাসের টানা যুদ্ধে গোটা দেশ বিধ্বস্ত, মুখের ভাত, চোখের ঘুম কেড়ে নেওয়া আরও অসংখ্য কালরাত। লাখ লাখ বাঙালির লাশের ওপর লাশের স্তূপের পাশে ধর্ষিতা নারীর, মৃতপ্রায় শিশুর, গুলি খাওয়া বাঘের মতো পায়ে পায়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর মরণ আশঙ্কার বিনিদ্র ক্ষুধাকাতর কালরাত।
বহুল প্রত্যাশিত স্বাধীনতা এল। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে সবুজের বুকে রক্তিম সূর্য উঠল। কিন্তু ভয়ংকর সেই সব কালরাত পেরিয়ে ভোর আদৌ হলো কী? স্বজনহারা মানুষের ক্রন্দন, উদ্বাস্তুর যন্ত্রণা, কোনোরকমে বেঁচে যাওয়া মানুষকে তো চিরতরে প্রতিবন্ধী করে দিল। যাঁদের দেশ চলে গেল তাঁদের আর নতুন করে দেশ হলো না, স্বাধীন দেশে দুর্নীতি বাসা বাঁধল। মুক্তিযোদ্ধারা পড়ে পড়ে মার খায়, লাথি–ঝাঁটা গুলি খেয়ে মরে। পাকিস্তানপন্থী রাজাকারেরা আগের মতোই ক্ষমতার ছড়ি ঘোরায়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের নিদারুণ অভিজ্ঞতায় অসংখ্য মানুষ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, মানসিক ভারসাম্যহীন মুক্তিযোদ্ধার হাসপাতালে গারদে ঠাঁই হয়।
তেমনই এক বেদনাবিদুর মর্মস্পর্শী কাহিনিকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন খান আতাউর রহমান। যে চলচ্চিত্রে জাহেদ নামের একজন মুক্তিযোদ্ধা অভিনেতা ফারুক, টানা ১৬–১৭ বছর ধরে মানসিক হাসপাতালের গারদে বন্দি। মাঝেমধ্যে শুধু চিৎকার করে, এখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখনো ভোর হয়নি। এখনো অনেক রাত।
খান আতাউর রহমান বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন বিরল মানুষ। এই চলচ্চিত্রটির কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক, গীতিকার, সুরকার এবং একটি চরিত্র, বাঁধনের বাবা হয়ে অভিনয়ও করেছেন তিনি। শুধু বাংলাদেশের চলচ্চিত্র কেন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও একই চিত্তে এত রূপ, বিরল প্রতিভার স্রষ্টা খুব কম আছে। জহির রায়হানের মতো প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকারের ছবিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতেন খান আতাউর রহমান। ‘এখনো অনেক রাত’ নিজের পরিচালনায় তাঁর শেষ চলচ্চিত্র। পরিচালকের হঠাৎ প্রয়াণের পর, ১৯৯৭ সালে এই চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। পরিচালকের যোগ্য পুত্র খান আসিফ আগুন দরদি কণ্ঠে এই চলচ্চিত্রে জন্মভূমির জন্য ভালোবাসার গান করেছেন এবং সাব্বির নামের এক মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয়ও করেছেন।
বিলেতফেরৎ মনের রোগের ডাক্তার নিতি চৌধুরী অভিনয়ে সুচরিতা, পাবনার মানসিক হাসপাতালের দায়িত্ব পেয়ে এসেছেন। সেখানে তিনি বহুবছর পর রোগীদের মধ্যে আবিষ্কার করলেন, তাঁর হারিয়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রেমিক জাহেদকে। মানসিক ভারসাম্যহীন জাহেদ থেকে থেকে শুধু চিৎকার করে ওঠে, আজাদ, সাব্বির, কামাল, বাঁধন তোরা কোথায়? তোরা কোথায়? দেশের জন্য আহাজারি, রক্তক্ষয়ী স্মৃতির ভেতর বেদনায় চিৎকার করতে করতে ঝিমিয়ে পড়ে। কখনো জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবে উত্তেজিত হয়ে কখনো ভাঙচুর বা কাউকে আক্রমণ করে না। নিজের ভেতর বেদনায় শুধু জ্বলেপুড়ে মরে।
মুক্তিযুদ্ধে একটা সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরে দলবল নিয়ে ঘুরে ঘুরে কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করত জাহেদ। নিতি আর্থিক সাহায্য পাঠাত। আজাদ, সাব্বির, কামালরা সবাই ছিল সহযোদ্ধা। সবাই মিলে খান সেনাদের ক্যাম্পে সাঁড়াশি আক্রমণ চালাত। ব্রিজ উড়িয়ে দিত। মাতৃভূমির জন্য মরণপণ লড়াইয়ে পাকিস্তানী সেনাদের যেমন মেরেছে, নিজেদের সহযোদ্ধা অনেককে হারাতে হয়েছে। যশোর সেক্টরে যুদ্ধ করার সময় কামাল কলকাতা গিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে এনেছিল। শেষ মুহূর্তের যুদ্ধের ময়দানে বুকে বুলেট বিদ্ধ হয়ে আহত হলো। জাহেদ তাকে ঢাকা হাসপাতালে নিয়ে এসে ভর্তি করল। কিন্তু স্বাধীনতার প্রথম দিনে জাহেদের হৃদয় শূন্য করে হারিয়ে গেল কামাল।
জাহেদ কামালকে কথা দিয়েছিল, তাদের বাড়ি গিয়ে বোন বাঁধন আর বাবাকে দেখে আসবে। কথা মতো কামালদের গ্রামে এসে দেখল, খান সেনাদের হাতে নিহত বাবা ঘুমিয়ে আছে কবরে। খান সেনারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এই গ্রামটাকেও স্বজনহারা মানুষের বেদনায় একেবারে শূন্য করে দিয়ে গেছে। স্বজনহারা, সম্ভ্রমহারা, ধর্ষিতা মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী স্বাধীনতার সন্ধানে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। এসব দেখে জাহেদ বাঁধনকে কামালের কথাটা আর বলে উঠতে পারল না। সদ্য পিতৃহীন কন্যা, ভাই হারানোর শোক সহ্য করতে পারবে না।
এই গ্রামে এসে আরও দেখল, ‘আল্লার মুল্লুক পাকিস্তান’ ধারণায় বিশ্বাসী রাজাকার মণ্ডল চেয়ারম্যান প্রশাসনিক অধিকারিককে পর্যন্ত কাজে লাগিয়ে মানুষের জন্য বরাদ্দ রেশনের খাদ্য চুরি করে। মণ্ডলের বদমায়েশ ছেলে যেকোনো উপায়ে বাঁধনকে বিয়ে করতে চায়। মানুষের যোগ্য প্রাপ্য, মানুষের অধিকার, মানুষের হাতে তুলে দিতে মুক্তিযোদ্ধা জাহেদ নতুন যুদ্ধের ময়দানে আবার লড়াই চালিয়ে যায়। সহযোদ্ধাদের বলে, এবার আর অস্ত্র হাতে নয়, স্বাধীন দেশে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। বুক চিতিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, মানুষের দাবিতে আওয়াজ তুললেই হবে। কিন্তু তা করতে গিয়ে দখলদারের পোষা দুষ্কৃতির গুলিতে সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়।
হারানো সহযোদ্ধার জন্য বুকফাটা আর্তনাদ করার সময়, হারানো বন্ধু কামালের জন্যও আর্তনাদ করে ওঠে জাহেদ। বাঁধন শুনতে পেয়ে যায়। মায়ের পেটের সহোদর ভাই একদিন ফিরে আসবে শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সে যে অপেক্ষায় ছিল। এখন মুহূর্তের মধ্যে সত্যিটা জেনে সব আশা শেষ, অসীম শূন্যতা ঘনিয়ে এল। পাগলের মতো দিশাহীন ছুটতে ছুটতে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিল। জাহেদও বোনকে বাঁচাতে জলে ঝাঁপ দিয়েছে।
বাঁধনকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একের পর এক ধাক্কা, শূন্যতা অতিক্রম করতে করতে জাহেদ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। নিতির চোখের সামনেই সেদিন এসব কিছু ঘটেছিল। জাহেদ নিজের স্বজনপরিজন সব কিছুকে হারিয়ে নিতির হৃদয়ে পেয়েছিল আশ্রয়। নিতি চোখের সামনে দেখেছে, যুদ্ধের ময়দানে ভালোবাসার হৃদয়টাকেও যেন খুঁইয়ে এসেছে জাহেদ। দেশ মাতৃকার মুক্তির থেকেও ব্যক্তি সম্পর্ক বড় নয়। আবার এই মানবিক সম্পর্কের বন্ধন জাহেদের কাছে কোনো অংশে ছোটও নয়। কামালের বোনকে তাই নিজের বোনের মতো বুকে টেনে নিতে পেরেছিল। সুখে দুঃখে যন্ত্রণায় নিতির বুকে গিয়ে জাহেদ খুঁজে নিত আশ্রয়।
সম্পর্কের টানাপোড়েন, দেশপ্রেম, বিবেক, মূল্যবোধ, সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ অনুভূতির নিখাদ বুননে উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্র। প্রখর হয়ে উঠেছে মানসিক চাপের, মন মননতন্ত্রের সাম্য ভারসাম্যর দোলাচল। মনের ডাক্তার নিতি চৌধুরী হারানো প্রেমিককে খুঁজে পেয়ে সুস্থ করে তুলতে বদ্ধপরিকর। নিতি চৌধুরী প্রেমিকের মাথায় ইলেকট্রিক শক দেয়। হারানো প্রিয়জন সহযোদ্ধাদের খুঁজতে খুঁজতে জাহেদ চিৎকার করে ওঠে। এখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি। এখনো ভোর হয়নি। এখনো অনেক রাত। আর্তনাদ করতে করতে জাহেদ মানসিক হাসপাতালের গণ্ডি ছেড়েও বেরিয়ে পড়ে। নিতি হারানো প্রেমিককে আগের মতো করে খুঁজে পাবে কি পাবে না, তার কোনো সঠিক দিশা নেই। নামের মধ্যেই অসীম শূন্যতা লুকিয়ে, এখনো অনেক রাত। মিলন নয়, পুনরায় মিলনের মধ্যেও বিরহ যন্ত্রণার ভাষা এই কাহিনির বাস্তবচিত্র।
তবে কিছু কিছু দিশা এই চলচ্চিত্রেও আছে। সাব্বির চূড়ান্ত অবসাদে নিজের গিটার ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল। জাহেদ তার কণ্ঠে গান থামতে দেয়নি। জাহেদরা সূর্যটাকে কেড়ে এনেছিল, যুদ্ধ করে স্বাধীনতার ভোর এনেছিল তা তো মিথ্যে নয়। নিজেদের জীবনের অন্ধকার দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করে গিয়েছে, আমাদের কষ্টের মর্ম দেশবাসী বোঝার চেষ্টা করো। স্বাধীনতার মূল্য তোমরা রক্ষা করো।
ববিতা, আলীরাজ, বুলবুল আহমেদ, শর্মিলী আহমেদ, ইনাম আহমেদ, হারুনুর রশীদ, ফাল্গুনী আহমেদ—সবাই এই চলচ্চিত্রে সুন্দর অভিনয় করছেন। বাস্তবে মুক্তিযোদ্ধা ফারুকের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার চরিত্রে অভিনয়ে যে আবেগ–অনুভূতি কাজ করেছে, বাকিরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, তাঁদের সেই পরিবেশ পরিস্থিতিতে–পৌঁছনোটাও খুব কষ্টসাধ্য বিষয়। খান আতাউর রহমানকে দেখে মনে হয়েছে, তিনি সেই সময়ে বেশ অসুস্থ ছিলেন। অসুস্থ অবস্থায় একটি চলচ্চিত্রের এতগুলো দিক সামলেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ যেমন ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ–আশ্রিত এই চলচ্চিত্রটিও ঐতিহাসিক সম্পদ হয়ে থাকবে।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত