যেভাবে এল বই দিবস

২৩ এপ্রিল ‘বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস’সংগৃহীত
নিঃসঙ্গতার সতিন হয়ে একাকী মুহূর্তে বই সঙ্গ দিয়ে যাবে আজীবন। তাই বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন, সর্বোপরি বইয়ের সঙ্গে থাকুন।

‘জীবনে তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। বই, বই এবং বই।’- লিও টলস্টয়

২৩ এপ্রিলকে পালন করা হয় বিশ্ব বই দিবস হিসেবে। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য বই পড়া, বই ছাপানো, বইয়ের কপিরাইট সংরক্ষণ করা, পাঠক তৈরি ও পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলা।

ইসলাম ধর্মের প্রধান ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের প্রথম নাজিলকৃত শব্দ ‘ইকরা’, যার অর্থ পড়ো। পড়ার প্রধান মাধ্যম হলো বই। সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছে, তা লিপিবদ্ধ করার বিভিন্ন মাধ্যম থাকলেও সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম যে বই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘বই অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দেয়।’ অতীতের অজস্র ঘটনাবলি নিঃশব্দে কানাকানি করে বইয়ের মধ্যে। এই ধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় বই পাঠের মধ্য দিয়ে।

কীভাবে এল বই দিবস
বিশ্ব বই দিবসের ধারণাটি প্রবর্তন করেন স্প্যানিশ লেখক ভিসেন্তে ক্লাভেল আন্দ্রেস। আন্দ্রেস ছিলেন স্পেনের বার্সেলোনার অধিবাসী। তিনি ছিলেন আরেক বিখ্যাত স্প্যানিশ লেখক মিগেল দে সের্ভান্তেসের ভাবশিষ্য। এই সের্ভান্তেস ছিলেন পৃথিবীর প্রথম দিককার আলোচিত একটি বই ‘ডন কিহোতো’র লেখক। সের্ভান্তেস মৃত্যুবরণ করেন ১৬১৬ সালের ২৩ এপ্রিল। নিজের প্রিয় লেখকের মৃত্যু দিবসকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯২২ সালের ২৩ এপ্রিল ভিসেন্তে বই দিবস শুরু করার কথা প্রস্তাব করেন। তবে এটি তখনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি।

বই দিবস প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্‌যাপিত হয় ১৯২৬ সালের ৭ অক্টোবর, সের্ভান্তেসের জন্মদিনে। তবে এই সময়টি বই ক্রয়-বিক্রয়ের অনুকূল না হওয়ায় চার বছর পরে ১৯৩০ সাল থেকে ২৩ এপ্রিল তারিখে বই দিবস পালিত হয়। দিবসটি কাতালোনিয়া রাজ্যে ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইউনেসকো এই দিনকে বিশ্ব বই ও কপিরাইট দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে।

২৩ এপ্রিল সের্ভান্তেস ছাড়াও ইংরেজ নাট্যকার উইলিয়াম শেক্‌সপিয়ার, পেরুর সাহিত্যিক ইনকা গার্সিলাসো দে লা ভেগা, বাঙালি সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়সহ সাহিত্যের আরও অনেক কৃতী মানুষের জন্ম ও মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। এ জন্য দিনটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে বই দিবস পালন করা হয় মার্চ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার।

২০০১ সাল থেকে ইউনেসকো একটি বিশেষ শহরকে ‘বই শহর’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রথম বছর স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদকে বই শহর হিসেবে মনোনীত করা হয়। গত বছর বই শহর হিসেবে মনোনীত হয়েছিল ঘানার রাজধানী আক্রা। এ বছর ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ শহরকে বই শহর হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।

প্রমথ চৌধুরী তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘বই পড়া’-তে প্রাতিষ্ঠানিক বই ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরের বইয়ের মধ্যে পার্থক্য এবং কোনটার গুরুত্ব অধিক, সেটা দেখিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, একটা দেশ কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, তা বুঝতে হলে সেখানকার কাঁচাবাজার অথবা বইয়ের দোকানে যেতে হবে। তিনি বলেছেন, দেখতে হবে মানুষ কী খায় আর কী পড়ে, তা থেকেই ধরে নেওয়া যাবে জাতির ভবিষ্যৎ। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ তাঁর আলোকিত মানুষ গড়ার হাতিয়ার হিসেবে তুলে নিয়েছেন বইকে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি তৃণমূল পর্যায়ে বই পৌঁছে দেওয়ার কাজ করছেন।

আমাদের দেশে খুব আড়ম্বরের সহিত বই দিবস পালন করা হয় না। তবে বইপ্রেমী পাঠকদের কাছে বইয়ের কদর কখনো হ্রাস পাবে না। নিঃসঙ্গতার সতিন হয়ে একাকী মুহূর্তে বই সঙ্গ দিয়ে যাবে আজীবন। তাই বই পড়ুন, বই কিনুন, প্রিয়জনকে বই উপহার দিন, সর্বোপরি বইয়ের সঙ্গে থাকুন।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা