পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপ্রেমী কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা

আহমদ ছফা

‘আমার কথা কইবে পাখি করুণ করুণ ভাষে
আমার দুঃখ রইবে লেখা শিশির ভেজা ঘাসে
আমার গান গাইবে দুঃখে পথ হারানো হাওয়া
আমার নাম বলবে মুখে মেঘের আসা যাওয়া
ইন্দ্রধনু লিখবে লিখন কেমন ভালোবাসে
দীঘল নদী করবে রোদন সমাধিটির পাশে’

আজ কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আহমদ ছফার ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০১ সালের ২৮ জুলাই তিনি এই ধরণি ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন। আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন অসংখ্য কবিতা, প্রবন্ধ ও সাহিত্য সৃষ্টি। লেখককে আমরা দেখতে পাই একজন প্রকৃতি ও শিশুপ্রেমী হিসেবে। প্রকৃতির প্রতি, বিশেষ করে পুষ্পবৃক্ষ, বিহঙ্গর প্রতি তাঁর ভালোবাসা হৃদয় স্পর্শ করে। আহমদ ছফা তাঁর ‘একরাত’ কবিতায় লিখেছেন, ‘এখন গভীর রাত—ঈশ্বরের পৃথিবী শান্ত নিসর্গ নিশ্চুপ নক্ষত্রের চোখে ঘুম, পশু, পাখি গাছপালা ঘুমে অচেতন আমার নিভৃত প্রাণে নিশাচরী তুলেছ কেতন জ্বালিয়ে দিয়েছ হু হু দাবানল এই রাতে পুড়িছে অন্তর। এখন গভীর রাত পৃথিবী নিদ্রার ঘোরে উলটে পালটে ঘুমন্ত শিশুর মতো, শান্ত বড় সুখাবেশমাখা সারাদেহ ভাঙ্গা হেমন্তের চাঁদ কৃশতনু নারী যেন ক্ষীণ স্নেহ।’

‘পুষ্পবৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ’–এ লেখক বলেছেন, ‘ফুল ফোটানো সহজ কথা নয় শূন্য থেকে মূর্ত করা সৃষ্টির বিস্ময়। পারে সে জন ভেতর থেকে ফোটার স্বভাব যার, ফালতু লোকের ভাগ্যে থাকে বন্ধ্যা অহংকার’। লেখক আহমদ ছফার বৃক্ষের প্রতি যে মায়া–ভালোবাসা সত্যি অকল্পনীয়। ‘সবুজ উদ্ভিদের যে একটা আত্মা রয়েছে, তার স্পর্শ আমার নিজের আত্মায় এসে লাগে। মুখে কোনো বাক্য আসতে চায় না। এইখানে ঈশ্বরের এই প্রাচুর্যের পাশে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।’ বৃক্ষ নিয়ে কী সুন্দর অনুধাবন লেখকের। মানুষের জীবন ও আত্মার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছেন। তিনি আপেল চারাকে আপেল শিশু এবং বৃক্ষচারাকে তরুশিশু বলে উপমা দেন।

কাক নিয়ে বলেছেন, ‘কাক একটু কর্কশ বটে কিন্তু কান খাড়া করে শুনলে তার ভেতর একটা চিকন রেশ পাওয়া যাবে। কেন যে পাখিটিকে নোংরা পাখি বলে আমি কারণ খুঁজে পাইনি। কাক চেষ্টায় বক ধ্যানং কাকের মতো চেষ্টা করতে হবে, বকের মতো ধ্যান করতে হবে। স্বল্পহার, স্বল্প নিদ্রা এবং গৃহত্যাগ বিদ্যার্থীর পাঁচটি লক্ষণ।’ লেখক বুলবুলি পাখির সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে। বুলবুলি পাখি খাবারে ঠোকর দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যেভাবে গানের সুর তোলে, সেটাকে তিনি পাহাড়ি ঝরনা বয়ে পাথরের ঘষা লেগে যে নরম ভেজা শব্দের সৃষ্টি হয়, তার সঙ্গে তুলনা করেন। আহমদ ছফা খাঁচায় করে শালিক ও টিয়া পাখি পুষতেন। টিয়া পাখি কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন যান্ত্রিক শহরে। শালিক পাখিকে পুত্র বলে সম্বোধন করেছেন। একদিন নিজের পোষা শালিক পাখিকে উন্মুক্ত করে দেন। পরে দেখেন এটি অন্য আরেকটি শালিক নিয়ে বাড়ির ছাদে ফিরে আসে। সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লেখেন, ‘আমার পাখি পুত্রটি একটি বউ জুটিয়ে নিতে পেরেছে দেখে খুব আনন্দ হলো।’ পাখির প্রতি আহমদ ছফার মুগ্ধতা এখানেই শেষ নয়। আরও লিখেছেন, ‘এই পুষ্প, বৃক্ষ, তরুলতা, বিহঙ্গ আমার জীবন এমন কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে যে আমার মধ্যে কোনো একাকিত্ব, বিচ্ছিন্নতা এখন আর অনুভব করি না। আমি পাখি পুত্রের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। পাখিটি আমাকে যা শিখিয়েছে, কোনো মহৎ গ্রন্থ, তত্ত্বকথা কিংবা গুরুবাণী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি। একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজেই মুক্তি অর্জন করতে পারে। এই আকাশের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি অমৃত সমুদ্রের অবগাহন নয়?’

আহমদ ছফা
ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

প্রকৃতি ও শিশুদের প্রতি ছিল লেখকের জলতরঙ্গ ভালোবাসা। নিজে সংসার করেননি, কিন্তু সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি বলতেন, ‘সকলে আমার মধ্যে আছে, আমি সকলের মধ্যে রয়েছি। শরীরের কোনো অংশ অসুস্থ হলে যেমন পুরো শরীর অসুস্থ হয়ে যায়, তেমনই দরিদ্র ও বস্তিবাসী শিশুদের শিক্ষা বঞ্চিত করে দেশকে সমৃদ্ধ করা যায় না।’ আহমদ ছফা শিশুদের মতো জীবন উপভোগ করতেন। প্রকৃতি ও শিশুদের মাঝে নিজের জীবনকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন, যেন মানুষ ও প্রকৃতি একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ যেন প্রকৃতির মাঝে তরুলতা হয়ে দুলছে আর খেলছে। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে।

সাহিত্যের মাঝে অনন্তকাল বেঁচে থাকুক কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখে গেছেন। মৃত্যু নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মৃত্যু হলো শোকের চেয়েও প্রয়োজনীয়, জীবিতদের জন্য জায়গা তৈরি করে। সৃষ্ট জীবের কলুষ কালিমা হরণ করে, জীবনকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।’
আহমদ ছফার প্রথম গ্রন্থ ‘বরুমতির আঁকেবাঁকে’। উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধসমূহের মধ্যে ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাংলা ভাষা’, ‘রাজনীতির আলোকে’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’, ‘বাঙ্গালি মুসলমানের মন’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘রাজনীতির লেখা, নিকট দূরের প্রসঙ্গ’, ‘সংকটের নানা চেহারা’, ‘সাম্প্রতিক বিবেচনা’, ‘শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ’, ‘বাঙ্গালি জাতি এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্র’, ‘আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’, ‘সেই সব লেখা’ ইত্যাদি। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘সূর্য তুমি সাথী’, ‘উদ্ধার’, ‘একজন আলী কেনানের উত্থান পতন’, ‘অলাতচক্র’, ‘ওঙ্কার’, ‘গাভীবিত্তান্ত’, ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’, ‘পুষ্পবৃক্ষ ও বিহঙ্গপুরাণ’, ‘নিহত নক্ষত্র’। কবিতার বইও লিখেছেন। ‘জল্লাদ সময় ও দুঃখের দিনের দোহা’, ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’, ‘লেনিন ঘুমাবে এবার’, ‘আহিতাগ্নি’। এ ছাড়া কিশোর গল্প, শিশুতোষ ছড়া ও ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন।

বন্ধু, প্রথম আলো বন্ধুসভা চট্টগ্রাম