বড়ুয়া, আইসসু না!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তখন সদ্য অষ্টম শ্রেণিতে। সরকারি বৃত্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিকাল। গণিতে একটু কাঁচা ছিলাম। সেজবাবা একদিন কাকডাকা ভোরে নিয়ে গেলেন এক শিক্ষকের কাছে। স্যারের নাম শুনেছি একটু–আধটু। রুমে ঢুকে দেখি মুখভর্তি সাদা দাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরা এবং সাদা টুপি মাথায় এক ব্যক্তি নামাজ পড়ছেন। রুমের দুই পাশে ছাত্রদের পড়ার বেঞ্চ, সঙ্গেই লাগানো একটি বিছানা। বিছানার সামনে একটি টেবিল, হাজারো নতুন-পুরোনো গণিত বই সেখানে।

যবুথবু হয়ে বেঞ্চিতে বসে আছি। সেজ বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। এরপর স্যার জিজ্ঞেস করলেন, কোথা হতে শুরু করতে চাই।  আমি স্যারকে ধীর গলায় একটি অধ্যায়ের নাম বললাম। স্যার বললেন, ‘তুমি যা পারো শুরু করো আগে, না পারলে আমার কাছে আসবে।’ উদাহরণ ঘেঁটে গণিতের ধরন বুঝে কয়েকটা করলাম। পরক্ষণেই কঠিন মুহূর্ত হাজির। স্যার তখন টিফিন বক্স হতে একটি প্লেটে ভাত আর তাতে পানি ঢেলে মাছ দিয়ে আরামসে খাচ্ছেন। ইতস্তত লাগছিল বলতে। স্যার আমার হাঁসফাঁস দেখে কাছে ডাকলেন। সেই খাওয়া অবস্থায় স্যার পুরো অংক বুঝিয়ে দিলেন অন্যভাবে, অন্য উপায়ে। অবাক বিস্ময়ে শুধু দেখে গেছি। বাম হাতে লিখছেন খাতায় আর ডান হাতে ভাতের লোকমা! কখন যে তিনঘণ্টা চলে গেল, বুঝতেই পারলাম না।

সেই ভোর ছয়টা থেকে সাড়ে ছয়টায় স্যারকে ঘুম থেকে তুলতাম। আর আমাকে দেখেই এক গাল মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘বড়ুয়া, আইসসু না!’ (বড়ুয়া, এসেছ?) এরপর গণিতের যত জাদুকরী মন্ত্র স্যার ঠান্ডা মাথায় শিখিয়ে যেতেন। স্যারের হাত ধরেই জ্যামিতির যমভীতি কাটানো শুরু করি। তিনি বাম হাতে জ্যামিতিক লজিকগুলো আঙুলের নখ দিয়ে কেটে কেটে খাতায় এঁকে দিতেন। আর আমি দ্বিগুণ উৎসাহে তা করে যেতাম। এভাবে তিন-চার ঘণ্টা কত সময় পার করেছি। সেই মুহূর্ত থেকে বুঝতে শুরু করি পড়ালেখার ধ্যান কাকে বলে!

নিভৃতচারী, প্রচারবিমুখ আমার প্রিয় মোতালেব স্যারকে আদাব, শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানাই।

সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া