বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরের বছরেই কাজী জহির নির্মাণ করলেন হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের প্রেম-প্রীতি-বন্ধুত্বের সুন্দর একটি চলচ্চিত্র ‘অবুঝ মন’। যাঁরা উত্তম-সুচিত্রা রোমান্টিক জুটির পুরোনো দিনের ছবির মোহে আচ্ছন্ন, এই ছবি তাঁরাও বেশ উপভোগ করবেন। এখানে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে রাজ্জাককে দেখে মনে হচ্ছিল একেবারে উত্তমকুমার আর শাবানা যেন অবিকল অপরূপা সুচিত্রা সেন।
চলচ্চিত্রের কাহিনি লিখেছেন চিত্রা সিনহা। বনেদি বাঙালি হিন্দু পরিবারের কন্যারত্নটি আবার ভালোবেসে কাজী জহিরকে বিয়ে করে চিত্রা জহির হন। কাহিনির যাত্রাপথেও আমরা দেখেছি, বনেদি হিন্দু জমিদার পরিবারের কন্যা মাধবী বন্দ্যোপাধ্যায়, মানে শাবানার সঙ্গে সদ্য ডাক্তারি পাস করা মুসলিম যুবক মাসুম, মানে রাজ্জাকের পরিচয় হয়। একপ্রকার প্রথম দর্শনেই প্রেম এবং পরবর্তী সময়ে তা তীব্র বিরহের আকার ধারণ করে। প্রথম দর্শনের খুনসুটি–দুষ্টুমিতে অভিজাত পরিবারের নারীর আভিজাত্য আর এলেবেলে ডাক্তারের তীব্র মান-অভিমানবোধ একে অন্যের জিনিস ট্রেনের জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। সেই ট্রেন হঠাৎ অচল হয়ে থেমে গেলে রাতের অন্ধকারে অজানা–অচেনা জায়গায় মাসুম আবার মাধবীর আশ্রয় হয়ে ওঠে। মাসুমের অনুরোধে মাধবী গান ধরে, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়/ চলার পথে ক্ষণিক দেখা/ একি শুধু অভিনয়...।’ একরাশ মুগ্ধ আবেশ ছড়ানো কালজয়ী এ গানটি পদে পদে আক্ষরিক অর্থে এই ছবির অমূল্য চাবিকাঠি হয়ে ওঠে।
‘এই অবুঝ মনে কে যে ক্ষণে ক্ষণে/ চুপি চুপি দোলা দেয়/ ওগো জোছনা তুমি বলো না/ কেন যে উতলা এ হৃদয়...।’ আবেগ ভরা দরদি গানের কথায় যেমন ছবির নামকরণ লুকিয়ে থাকে, আবার একই গন্তব্য পথের পথিক দুটি হৃদয় একই গ্রামে গিয়ে দুজন দুজনের জন্য উতলা হয়ে ওঠে। জমিদারকন্যা এবং অসুস্থ বাবার আসনে সদ্য জমিদারিতে বসা মাধবীর আসল পরিচয় জানতে পারে মাসুম। আর শহর থেকে ডাক্তারি পাস করে গ্রামের অসুস্থ পীড়িত দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতে আসা সহযাত্রী ডাক্তার মাসুমকে চিনতে পারে মাধবী। প্রেম কখনো ধনী-গরিব শ্রেণিবিভাজন, জাত–ধর্মের বেড়াজাল মানে না। সমাজের সব বিভাজন অগ্রাহ্য করে দুজন দুজনকে মন দিয়ে বসে। এই ছবির সুরকার আলতাফ মাহমুদও অনবদ্য সুরের মূর্ছনায় মালার মতো প্রতিটি দৃশ্যের অতল সুর বুনে দিয়ে গোটা চলচ্চিত্রকে সুন্দর একটি সুরের সফর করে তুলেছেন। সুর যদি মালার ফুলের গন্ধ হয়, তাহলে চিত্রনাট্য ধরে প্রতিটি চলমান দৃশ্যের ফুলগুলোকে অনবদ্য মুনশিয়ানায় হৃদয়–দৃশ্যগ্রাহ্য করে তোলেন চিত্রগ্রাহক আবদুল লতিফ বাচ্চু।
শহরে ডাক্তারি পড়ার সময় মুসলিম মাসুমের মাথার ওপরে অনেক বড় আশ্রয় ছিল হিন্দুধর্মের সুহৃদ বন্ধু বিজয়। হিন্দুবাড়ির আশ্রয়ে মুসলিম মাসুমের কখনো জাত যায়নি। বরং মাসুমের মনের প্রতিটি কথা মুখে না শুনেও অক্ষরে অক্ষরে বুঝে এসেছে বিজয়। আজও ডাক্তার বন্ধুর পাশে দাঁড়ানোর জন্য এবং বন্ধুর মাধ্যমে গ্রামের গরিব–দুঃখীদের সেবা করার জন্য শহর থেকে সাহায্য পাঠায় সে। এই সাহায্য এমন একটা সময়ে মাসুমের হাতে এসে পৌঁছায়, যখন নিজের জন্য নয়, অন্যের তরে জীবন বিলিয়ে দিতে সত্যিকারের সাহায্যের তার খুব দরকার ছিল।
চিত্রা সিনহা ভালোবাসার সুন্দর চিত্রাক্ষর বুনেছেন। আর কাজী জহির সেই অমৃত চিত্রাক্ষরকে নিপুণ বন্ধনে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন। তাঁদের ব্যক্তিজীবনের প্রেমের বন্ধনের মতোই সুন্দর এই চলচ্চিত্র।
মাসুম-মাধবীর প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় আজন্মলালিত বনেদি আভিজাত্য আগ্রাসী রক্তের আগুন আর ধর্মীয় সংস্কার। দুজনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল একে অন্যকে ছেড়ে কখনো কিছুতেই যাবে না। মাধবীর বাবার কাতর অনুনয়–বিনয়ের কাছে এবং অসুস্থ হয়ে পড়া বৃদ্ধের প্রাণ বাঁচাতে ডাক্তারি নীতি–ধর্মের কাছে মাসুমকে তবু হার মানতে হয়। যে ট্রেনে চেপে প্রথম আলাপে প্রেমে পড়ে দুজন গ্রামে এসেছিল, আজ ব্যর্থ প্রেমিক–হৃদয় নিঃসঙ্গ একাকী সেই ট্রেনে চেপে গ্রাম ছেড়ে যায়। এই ব্যর্থ প্রেমিকের চরম হৃদয়–দগ্ধ ব্যথার প্রতিফলন হয়ে ওঠে একই গানের পরের কথাগুলো, ‘জানি সাঁঝের বেলা ফেলে সকল খেলা/ নীড়ে পাখি ফিরে যায়/ তবু আকাশে, গানের আভাসে/ চলারও কাহিনি লেখা রয়।’
ছবির কাহিনি অন্য রকম অনবদ্য রূপ নেয়। এত সুন্দর কাহিনির বুনন পরিচালকের দক্ষ পরিচালনায় বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি যুগের স্বাক্ষর রেখে যায়। এক চিরন্তন অমর প্রেমকাহিনির আসনে ছবিকে ইতিহাসের পথে এগিয়ে দিয়ে যায়। মাধবীর জমিদার বাবা যে বন্ধুর ছেলের সঙ্গে কন্যার বিয়ে ঠিক করেছে, সে হলো বিজয়। বিজয় জানে না, জানতেও পারে না, যাকে সে অগ্নিসাক্ষী করে হৃদয়ের দোসর করল, সে তারই প্রিয়তম বন্ধুর প্রেমিকা। পিতার চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করা মাধবী বাসররাতে বরকে নিজের জীবনের সব কথা জানিয়ে দেয়। ফুলের বাসরে কাঁটার দগ্ধ ব্যথায় বিজয়ের জীবনে নেমে আসে কালোরাত্রি, অগ্নিপরীক্ষা। বিজয় চরিত্রে কিংবদন্তি অভিনেতা শওকত আকবর অনন্য নজির রেখেছেন।
ডাক্তারি পড়ার সময় থেকেই মাসুমকে ভালোবাসত রাবেয়া। শহর ছেড়ে যাওয়া মাসুমকে একমুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেনি সে। প্রতীক্ষায় ছিল এক দিন না এক দিন মাসুম ঠিক তার জীবনে ফিরে আসবে। আজ অসহায় দগ্ধ হৃদয়ের মাসুমকে আবারও কাছে ফিরে পেয়ে আদরে–সোহাগে সে আগলে রাখতে চায়। আর বিজয়ের বাড়িতে গিয়ে মাসুম একসময় জানতে পারে তার প্রাণপ্রিয় মাধবী এখন বিজয়ের ঘরনি। মাধবী জানতে পারে বিজয়ের অকৃত্রিম বন্ধু মাসুম। আর বিজয় জানতে পারে মাধবীর জীবনের সেই পরম পুরুষ আসলে তারই বন্ধু মাসুম। কে কাকে ছাড়বে আর কে কাকে ধরে রাখবে এখন? টানটান ছবির প্রতিটি দৃশ্যে নিপুণ সম্পর্কের বুনন, জটিল ধাঁধা, সম্পর্কের সুতার কাটাকাটি।
দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব এমনই যে দুজন দুজনের জন্য প্রাণপ্রিয়াকে ছেড়ে দিতে প্রস্তুত। মাধবীও এখন শুধু মাসুমকেই চায়। ব্যর্থ সম্পর্কের রিক্ত যন্ত্রণা তুঙ্গে ওঠে। গাড়ি দুর্ঘটনায় বিজয়ের দুটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। অধ্যাপক-ডাক্তার চরিত্রে খলিলউল্লাহ খান জানিয়ে দেন, এই দুটো চোখ আর কোনো দিন আলো ফিরে পাবে না। ডাক্তার মাসুম কিন্তু বন্ধুর অন্ধ চোখে বাকি সবার হৃদয়ের বন্ধ দুয়ার খুলে আলো ফিরিয়ে দিতে প্রস্তুত। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব?
অধ্যাপক ডাক্তারকে বহু কষ্টে রাজি করিয়ে গোপনে নিজের চোখের বিনিময়ে মাসুম বিজয়ের চোখ ফিরিয়ে দিতে চায়। ডাক্তার জানায়, এটাই হবে তার জীবনের শেষ অপারেশন। আর মাসুমকে শেষ পর্যন্ত রাজি করায় একটি চোখ দান করতে। প্রিয়তম মাসুম চোখ হারাতে চলেছে জেনে রাবেয়ার হৃদয় জ্বলে যায়। অপারেশনের পর সব জানতে পেরে মাধবীর দুচোখ পানিতে ভেসে যায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জমিদার বাবাকে বলে, ‘ধর্ম দিয়ে কখনো মানুষের বিচার কোরো না। দেখো বন্ধুর জন্য বন্ধু কেমন নিজের চোখ পর্যন্ত দান করে দিতে পারে।’
বিজয় দৃষ্টি ফিরে পায়। সব জানতে পেরে বন্ধু মাসুমকে বুকছাড়া করতে চায় না। মাসুম এবার মাধবীকে বিজয়ের হাতে তুলে দেয়। তার ভালোবাসা সত্যিকারের পূর্ণতা পাবে আজীবন মাধবী যদি বিজয়ের হাত ধরে রাখে। আর মাধবী ও বিজয় মিলে রাবেয়ার হাত তুলে দেয় মাসুমের হাতে। ভালোবাসা চার অক্ষরের মতো চারটি প্রাণের মহামিলন ঘটে। মোহনায় এই তিরতিরে চারটি নদীর গতিপথের নাম অবশ্যই ‘অবুঝ মন’।
ছবির অন্য গানগুলোও ভালো লাগে। গানগুলো রচনা করেছেন মনিরুজ্জামান ও গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চিরন্তনী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন সাবিনা ইয়াসমীন, আবদুল জব্বার ও ফেরদৌসী রহমান।
রাবেয়া চরিত্রে সুজাতাকেও ভোলা যাবে না। এ ছাড়া অভিনয় করেছেন নারায়ণ চক্রবর্তী, এ টি এম শামসুজ্জামান, চাষী নজরুল ইসলাম, সাইফুদ্দিন, খান জয়নুল, হাসমত, জাভেদ রহিম, ওয়াহিদা, দীন মোহাম্মদ, তেজেন চক্রবর্তী, শেখ ফজলু, মজিদসহ অনেকে।
চিত্রা সিনহা ভালোবাসার সুন্দর চিত্রাক্ষর বুনেছেন। আর কাজী জহির সেই অমৃত চিত্রাক্ষরকে নিপুণ বন্ধনে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন। তাঁদের ব্যক্তিজীবনের প্রেমের বন্ধনের মতোই সুন্দর এই চলচ্চিত্র।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত