শাড়ি

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান
মীরা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এত দিন পরতে দাওনি কেন? ছেলেপক্ষ এল আর নতুন শাড়িটা বের করলে!’

শম্ভুবাবু তাঁর মেয়ে মীরার ঘরে এসে স্ত্রীকে বললেন, ‘ছেলেপক্ষের লোক চলে এসেছে। আমি তাদের ড্রয়িংরুমে বসাচ্ছি। তুমি মীরাকে তৈরি করে নিয়ে এসো।’ স্ত্রী দুর্গা রানী বললেন, ‘তুমি যাও, আমি আসছি।’

নিজের মেয়েকে সাজিয়ে দিচ্ছেন তিনি। স্বামী, দুই মেয়ে, বৃদ্ধ শাশুড়ি আর দূরসম্পর্কের এক ননদ নিয়ে সংসার। রান্নাসহ বাড়ির যাবতীয় কাজ নিজ দায়িত্বে করে ফেলে ননদ মালতী। ননদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও অনেক ভালো।

আলমারি থেকে নীল রঙের একটা জামদানি শাড়ি বের করলেন মীরার মা। দুমাস আগে শাড়িটা কিনেছিলেন তিনি। মীরা এর মধ্যে কয়েকবার শাড়িটা পরার জন্য বায়না ধরেছিল। কিন্তু দুর্গা রানী পরতে দেননি। আজকের জন্য রেখে দিয়েছিলেন। মীরা তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এত দিন পরতে দাওনি কেন? ছেলেপক্ষ এল আর নতুন শাড়িটা বের করলে!’

‘শাড়ি তো তোর জন্যই কিনেছিলাম। এমনি পরলে ময়লা হয়ে যাবে, তাই দিইনি। আজ যেহেতু দরকার, বের করেছি।’

দুর্গা নিজে তেমন সাজতে না জানলেও মেয়েকে ভালোই সাজিয়েছেন। শাড়িটা ভালো করে পরিয়ে দিলেন। দুর্গা যখন মীরাকে সাজাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ অতীতের স্মৃতিতে হারিয়ে গেলেন।

কিশোরী বয়সে প্রথমবার যখন তাঁকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসে, তখন দুর্গাকে তাঁর বড় ভাই মামার বাড়িতে নিয়ে যান। দুর্গাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ হলেও মামাদের ভালো ছিল। তাই ভাগনির বিয়ের জন্য মামারা চেষ্টার কমতি রাখেননি! যদিও মানুষ যাতে পেছনে কটুকথা বলতে না পারে, সে জন্য তাঁদের এত চেষ্টা।

তখন শরৎকাল, কখনো মেঘ, কখনো বৃষ্টি আবার রোদ। এমনই এক দিনে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো; পাশের দোকান থেকে খবর এল, ছেলেপক্ষ আসছে, মেয়েকে যেন দ্রুত তৈরি করে রাখা হয়। মাসিরা দুর্গাকে সাজিয়ে দিলেন।

ঘর সাজানোর কমতি রাখেননি তাঁরা। বিপাক হলো শাড়ি নিয়ে। এমন একটা শাড়ি দুর্গাকে পরানো হলো, যেটি ছিল পুরোনো। তারপর যা ঘটেছে, তা আজও দুর্গার মনে পড়ে।

ছেলেপক্ষের এক মাসি অতিথিভরা কক্ষে হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘আপনাদের বাড়িঘর-আসবাবপত্র, অ্যাপায়ন দেখে তো গরিব বলে মনে হয় না। তবে মেয়েকে এমন একটা শাড়ি পরিয়ে কীভাবে আনলেন সবার সামনে, বাড়িতে কি শাড়ির অভাব ছিল?’ দুর্গা তখন মাথা নিচু করে ছিলেন। তাঁর দুচোখে জল। ছেলেপক্ষ কনে দেখা শেষ হয়েছে বলার পর দুর্গাকে অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবনের এত বছর পরও ঘটনাটা ভুলতে পারেননি তিনি। বাড়ি গিয়ে যখন দুর্গা কেঁদে কেঁদে মাকে বলেছিলেন কথাটা, তখন তাঁর মা বলেছিলেন, ‘আমরা গরিব রে মা, এত অভিযোগ করতে নেই। তোর বাবাকে বলে নতুন একটা শাড়ি আনাব হাট থেকে।’ বিয়ের আগে সেই নতুন শাড়ি আর দুর্গার ভাগ্যে জোটেনি।

‘মা, আমার হাতঘড়িটা কোথায়?’ মীরার কথায় স্বাভাবিক হলেন দুর্গা রানী। মেয়েকে শাড়ি পরাতে গিয়ে কিছুক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন। হাতঘড়িটা ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে খুঁজে বের করে দিলেন তিনি। এদিকে দরজার ওপাশ থেকে শম্ভুবাবু ডাকছেন, ‘এই, তোমাদের কি হলো? ছেলেপক্ষ যে তাড়া দিচ্ছে, মীরাকে নিয়ে এসো দ্রুত।’ ‘এই তো হয়ে গেছে, এক্ষুনি আসছি। তুমি মালতীকে বলো শরবত, মিষ্টি আর ফলগুলো কেটে দিতে।’ ‘সেসব অনেক আগেই হয়েছে। তুমি মীরাকে নিয়ে আগে আসো তো।’

মেয়েকে ছেলেপক্ষের সামনে নিয়ে এলেন দুর্গা রানী। নিজের হাতে মেয়েকে সাজিয়েছেন। শাড়িটাও নতুন। অন্তত শাড়ির জন্য তাঁর মেয়েকে ছেলেপক্ষের সামনে লজ্জা পেতে হবে না।

বন্ধু, নরসিংদী বন্ধুসভা