একজন মানবিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান (ডানে)ছবি: লেখকের সৌজন্যে
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনার জীবনের চাওয়া–পাওয়া কী?’ তিনি বললেন, ‘কিছুই চাওয়া–পাওয়ার নেই। বঙ্গবন্ধুর তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটা চাওয়া, এই স্বাধীন দেশে যেন সঠিক গণতন্ত্রটা বেঁচে থাকে অনন্তকাল।’

‘ওরা আসবে চুপি চুপি/ যাঁরা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ/ সব কটা জানালা খুলে দাও না/ আমি গাইব, গাইব বিজয়েরই গান’—২০০৬ সালের ২৬ মার্চ পটিয়া বন্ধুসভার মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি অনুষ্ঠানে গুনগুন করে গানটি গাইছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান।

গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতার ৫২ বছর পেরিয়ে একসময় একাত্তরের সেই গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠতাম। চোখে দেখিনি একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধের নাটক, ছবি আর ইতিহাস পড়ে উপলব্ধি করতাম, যুদ্ধের স্মৃতিকথা শুনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতাম। মুক্তিযোদ্ধা সেজে ভাবতাম অনেক শত্রুসেনাকে শেষ করব, দেশ স্বাধীন করব, স্বপ্ন ডানায় চড়ে, লাল–সবুজের বিজয় নিশান কপালে বেঁধে সারা দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের একত্রিত করে আনন্দ মিছিল করব। বিজয় মিছিলের স্লোগান হবে, জয় বাংলা! জয় বাংলা!

শিকড়ের কাছে শোনা সেই গল্প, মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রজন্ম হয়ে হৃদয়ের গহিনে ধারণ করে স্বপ্ন ফেরি করে বেড়ানো। যুদ্ধদিনের গল্প স্মৃতির ঝাঁপিতে রাখার চেষ্টা করেছি মাত্র। লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই নক্ষত্র মাটি। যে মাটিতে সবাই হেসেখেলে ঘুরে বেড়ায়, জোছনাভরা রাতে জোছনা উপভোগ করে, বৃষ্টির দিনে বৃষ্টিতে ভেজে। জাঁকিয়ে যখন শীত নামে কুয়াশার চাদর ছিঁড়ে প্রভাতফেরিতে যায় এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ। সুখ-দুঃখ একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করে, শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা যেন সোনার বাংলাদেশ। এত সুন্দর আমার দেশের মাটি বিশ্বের আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ।

মা-মাটির টানে যুদ্ধে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী পটিয়া পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুল মান্নান। যাঁকে আমি মামা বলে সম্বোধন করি। তিনি ১৯৫৪ সালের ১৩ জানুয়ারি পটিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মনির আহমদ ও মাতা দেলোয়ারা খাতুন। এলাকায় তিনি ছাতা মান্নান নামে পরিচিত। ১৯৮৫ কি ’৮৬ সালের দিকে পটিয়া ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছিলেন। প্রতীক ছিল ছাতা। সেই থেকে ছাতা মান্নান নামে পরিচিত। পড়ালেখায় হাতেখড়ি শশাংক মালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। ১৯৬৯ সালে পটিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ১৯৭২ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ছেলেবেলায় বেশ ফুটবল খেলতেন। ছিলেন নামকরা গোলরক্ষক।

মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, ‘১৯৭১ সালের কথা, তখন চট্টগ্রাম কারিগরি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করি। ছাত্ররাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে যাই। কারিগরি কলেজের ছাত্রলীগের নির্বাহী পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলাম। ভিপি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল হারুন এবং জিএস মিরসরাইয়ের তুষার কান্তি দাশ।

এরই মধ্যে দেশে ঝামেলা লেগে গেল। ৬ মার্চ বন্ধুরা মিলে চায়ের দোকানের রেডিওতে ভাষণ শুনছিলাম। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ভাষণ শুনে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশের জন্য কাঁধে অস্ত্র তুলে নেব।’

‘মাদক, ইয়াবা ও কিশোর গ্যাংমুক্ত সুন্দর একটি আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণদেরকে পড়ালেখা করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান

যুদ্ধদিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আবদুল মান্নান বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর ১৯ মিনিটের সেই ভাষণ এবং চট্টগ্রামের তৎকালীন শীর্ষ নেতা এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার, আবু ছালেহ, আইয়ুব বাঙ্গালী, ছাবের আহমেদ, মিয়া ফারুকী, শহীদ মৌলভী সৈয়দ আহমদসহ আরও অনেকে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। চারদিকে শুধু লাশ, আর বেঁচে থাকা মানুষের আহাজারি। ২৬ ও ২৭ মার্চের দিকে আমরা ষোলশহর ২ নম্বর গেট এলাকা অবরোধ করে পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। সে সময় সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকলে কর্নেল শওকত, ক্যাপ্টেন হারুন, সামরিক বাহিনী ও ইপিআর বাহিনীসহ কালুরঘাট ব্রিজ দিয়ে আপেলের টেক ও বোয়ালখালী পেত শাহ দরগাহ গেটে ছুটে আসি। সেখানে অবস্থান নিয়ে কিছু সময় অতিবাহিত করি। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা অতর্কিত গুলি চালালে ক্যাপ্টেন হারুন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁকে পটিয়া নিয়ে আসি।’

‘পরে আমরা দলবদ্ধ হয়ে অধ্যাপক শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রায় ২২ জনের মুক্তিবাহিনীর একটা দল গঠন করে ফেলি। রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি হয়ে ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্যে বগাফা বিএসএফ ক্যাম্পে চলে যাই। সেখানে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে ১০-১১ দিনের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর কিছু অস্ত্র ও গ্রেনেড সঙ্গে নিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হয়ে বোয়ালখালী প্রবেশ করি এবং একসময় আমরা বোয়ালখালী এসে রাঙ্গুনিয়ার বেতাগীর অধিবাসী পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কর্পোরাল শহীদ ক্যাপ্টেন করিমের সহযোগিতায় ধলঘাট, গৈড়লা গ্রামের প্রয়াত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বামপন্থী নেতা আহমেদ হোসেনের বাড়িতে অবস্থান করি। সে সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন অনিল লালা, রফিক আহমদ। ক্যাপ্টেন করিমের নেতৃত্বে রাউজান, কাপ্তাই, রাজস্থলী, পটিয়া, বোয়ালখালী এবং চন্দনাইশের কিছু অংশে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য রাস্তাঘাটে প্রতিরোধ গড়ে তুলি, ব্রিজ–কালভার্ট উড়িয়ে দিই। ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী পটিয়ায় ইন্দ্রপুল, থানার মোড়, গোবিন্দারখীল, হাইদগাঁও কেলিশহর এলাকায় বোমা হামলা করলে প্রায় ২০ জন শহীদ হন। ১৩ ডিসেম্বর পটিয়া হানাদারমুক্ত হয়। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৩ ডিসেম্বর পটিয়ায় বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক আবু সৈয়দ, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মহসিন খান ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার অধ্যাপক শামসুল ইসলামের নেতৃত্বে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করি। যুদ্ধকালীন পুরাতন কাপ্তাইয়ের রাজস্থলী বাজারে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হন পটিয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের মাঝের ঘাটার প্রিয় বন্ধু রফিক আহাম্মদ ওরফে রউফ। তাঁর মৃত্যুর খবরটি বেশি কষ্ট দিয়েছে। তাঁর কবরটি কাপ্তাইয়ে। সবচেয়ে বড় বিষাদের স্মৃতি মায়ের মৃত্যু।’

‘যুদ্ধ–পরবর্তী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সবচেয়ে বেশি ব্যথিত হয়েছিলাম, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার ঘটনা। বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে এই বাংলাদেশের জন্ম হতো না। যাঁর ডাকে সেদিন সবাই একত্রিত হয়েছিলাম দেশ স্বাধীন করতে।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান পেশায় ছিলেন একজন ঠিকাদার। ১৯৮৭ সালের দিকে পটিয়া পল্লী বিদ্যুৎ অফিসে ঠিকাদারি করেন। ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানার দক্ষিণ শুকছড়ি দরবার শরিফের আওলাদ সৈয়দা দিলরুবার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির তিন পুত্র ও তিন কন্যা।

কর্মজীবন শেষ করে বর্তমানে মানবসেবায় নিয়োজিত এই মহান ব্যক্তি। নিজের অর্জিত সঞ্চয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতার পুরো টাকা ব্যয় করেন মানবসেবায়। নিজের বাসভবনে প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তির আলো ফাউন্ডেশন, এতিমখানা ও প্রয়াত মা-বাবার নামে মনির-দেলোয়ারা বৃদ্ধাশ্রম। নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে পারলেই তাঁর আনন্দ। একাত্তরের দামাল মান্নান মামারা শুধু দেশ স্বাধীন করেননি। প্রতিনিয়ত করে আসছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ। একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক মানবিক মান্নান মামারা সোনার মানুষ।

এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আপনার জীবনের চাওয়া–পাওয়া কী?’ তিনি বললেন, ‘কিছুই চাওয়া–পাওয়ার নেই। বঙ্গবন্ধুর তনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটা চাওয়া, এই স্বাধীন দেশে যেন সঠিক গণতন্ত্রটা বেঁচে থাকে অনন্তকাল।’ কিছু আফসোসও আছে তাঁর। বলেন, ‘নিজেকে এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে। বড় দুঃসময় চলছে। ভুয়া এবং নীতি–নৈতিকতাহীন অনেকে মুক্তিযোদ্ধার সনদ নিয়ে বসে আছেন। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধাকে অপমানিত হতে হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা প্রত্যাশা করি না। এর জন্য কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম?’

তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অসম্মান করবেন না। মাদক, ইয়াবা ও কিশোর গ্যাংমুক্ত সুন্দর একটি আগামীর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তরুণদেরকে পড়ালেখা করে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তরুণ সমাজ এগিয়ে গেলে আগামীর বাংলাদেশ তাঁদের হাত ধরে এগিয়ে যাবে। দেশ, মা, মাটি ও মাতৃভূমিকে ভালোবাসুন। জয় বাংলা!’

বন্ধু, চট্টগ্রাম বন্ধুসভা