গল্পেরা ভেসে আসে অনিন্দ্যসুন্দরে

প্রতীকী

ঘন অন্ধকারে কুসুম কুসুম ঘুমটা ভাঙে মসজিদের মাইকের আওয়াজে। দরাজ কণ্ঠে কেউ বলে ওঠে, ‘উঠুন সাহ্‌রি খাওয়ার সময় হয়ে গেছে’—এই যে প্রতিবছর এমন ঘুমভাঙানির ডাক শুনে জেগে ওঠা, এতে কোনো বৈপরীত্য নেই যেন। সেই শৈশব-কৈশোর আর আজকের নিশিপালনে এইটুকুও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কেমন ঘুমে ঢুলুঢুলু ভাব। অসাবধানী ছেলেমানুষি। এই এতটা বছর পর। এখনো ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছি।

আব্বার সঙ্গে খেতে বসে প্রায়ই গল্প হয় পুরোনো কিছু নিয়ে। এই যেমন কুপিবাতির আলোতে নৈশভোজ। সাহ্‌রি ও ইফতারে নাগরা বা ঢোলের বিকট সতর্কধ্বনি কিংবা কৌতুকপটু নিশাচর কোনো গ্রাম্য লোকের গল্প। সেসব পুরোনো রাত্তিরের গল্প আমাকে প্রলুব্ধ করে ঠিক। কিন্তু আমি আয়েশ বোধকরি ভিন্ন কিছুতে। আমার শৈশবে। নদীর গর্ভে হারিয়ে যাওয়া আমার ভিটামাটি আর পথঘাটের বর্ণনাতে। বারবার একই গল্প মুখে আওড়াই। অমুকে তমুকে বলে বেড়াই। তবু আশ মেটে না। এ যেন দক্ষ হাতে লেখা কোনো মহান রচয়িতার সুখপাঠ্য উপন্যাস। কোনো গল্পেই আমি মূল চরিত্রের কেউ নই। এমনকি সহকারীও নই। অবান্তর কেউ। যাকে ছাড়াও ঠিকই থাকে পুরো স্ক্রিপ্ট। কোথাও কোনো কমতি পরিলক্ষিত হয়নি। ছেলেবেলায় নিজের এমন দৈন্যদশায় যে একদমই কষ্ট হয়নি, এমনটা নয়। কিন্তু এখন মোটেই অভিযোগ নেই। আমার আবশ্যিক কেউ হয়ে ওঠার দরকার নেই। তাচ্ছিল্যভর্তি সেই অবস্থানটা হলেই হবে। তবু সবকিছু ফিরে আসুক। শুধু একটিবারের জন্য ফিরে আসুক সেসব দিন।

বর্ষার দিন। চারদিকে রমজানের পবিত্র উচ্ছলতা। রোজার দিন। দুপুরে পানির তৃষ্ণা। বিকেলে রান্না দেখে লোভ সামলাতে না পেরে রোজা ভেঙে ফেলা। তারপর অন্ধকার রাত্তিরে শুয়ে শুয়ে আসন্ন ঈদকে ভেবে চাপা উত্তেজনা। অবচেতনেই হারিয়ে যাই এসব ভেবে ভেবে। হারিকেনের আলোতে সন্ধ্যায় বাংলা বইয়ের ছড়া কাটার অভিনব আনন্দ আমাকে এখনো শিহরিত করে।

ভোররাতে মুরব্বি গোছের যে লোকটা প্রতিনিয়তই সাহ্‌রি খেতে ডাকতেন, তিনি মারা গেছেন সেই কবেই। আমাদের বাড়ির কাছের মসজিদটাও নদীতে ভেঙে গেছে। লতাপাতার ঝোপঝাড় আর গাছের অন্ধকারে যে রাস্তা দিয়ে ভয়ে তারাবিহ পড়তে যেতে পারতাম না, সে রাস্তাটাও এখন আর নেই। স্কুলে টেকার ভয়ে পালিয়ে এসেছে যে পিচ্চি মেয়েটা, তার বিয়ে হয়ে গেছে। খেলাধুলা আর আমোদপ্রমোদে মত্ত সিনিয়রদের অনেকেই এখন যথেষ্ট সংসারী। বেজায় গুরুগম্ভীর।

আমাদের ভোররাতের গল্পের কোনো সীমারেখা নেই। অসংখ্য দীর্ঘশ্বাস আর আক্ষেপে সে মিশে যায় উজ্জ্বল তারার আকাশে। কখনো–বা ছুটে যায় মাইলের পর মাইল দূরে অচিন নগরে।

হাটহাজারী, চট্টগ্রাম