‘সরল সমাজপাঠ’ মানস চৌধুরীর একটি শ্লেষাত্মক রচনা সংকলন

মানস চৌধুরীর ‘সরল সমাজপাঠ’ছবি: সংগৃহীত

‘সরল সমাজপাঠ’ বইটি হাতে নিতেই লাল প্রচ্ছদে দুজন মানুষের কৌতূহলী অবয়ব। কী নিয়ে এ কৌতূহল? সেটা জানতে যে ততক্ষণে পাঠক মনেও কিছুটা কৌতূহলের সঞ্চার ঘটেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পৃষ্ঠা ওলটাতেই সূচিপত্রে নিবন্ধ দৃষ্টি। বিভিন্ন সময়ে রচিত ছোট ছোট উনিশটি নিবন্ধ/প্রবন্ধের সংকলন নিয়ে ‘সরল সমাজপাঠ’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে বইটি। শিরোনামে সরল কথাটি উল্লেখিত থাকলেও প্রথমবার মানস চৌধুরীর লেখা পড়তে গিয়ে যে কিছুটা তালগোল পাকিয়ে এলোমেলো মনে হচ্ছিল, সেকথা অস্বীকার করছি না। অবশ্য এই জটিলতা কাটাতে খুব বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। চোখের সামনেই ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক আবহমান বিষয়াবলিকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে শ্লেষাত্মক ঢংয়ে তিনি পাঠক হৃদয়কে নাড়া দিতে চেয়েছেন। উন্মোচন করতে চেয়েছেন ভাবনার দুয়ার। এক্ষেত্রে লেখক মোটামুটি সফল হয়েছেন বলেই মনে হচ্ছে।

শুরুতেই সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি বলতে এই সময়ের ভাবনা এবং সেই গবেষণা চালানোর চমৎকার উপায় সম্পর্কে বলেছেন তিনি। গবেষণার বিষয় সম্পর্কিত টপিক হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘ছাগল দিয়ে হালচাষ হয় না’। দুটো প্রমাণ সাইজের ছাগল, মানানসই মাপের হাল সমেত জমিতে নামার পর কী কী হতে পারে, আর এর ফলাফল সম্পর্কিত সমস্ত সম্ভাব্যতা আলোচনার পর লেখকের আপ্ত বাক্য, ‘মোটকথা হলো, সামাজিক গবেষণার জগতে আমরা চাই যে সামাজিক জ্ঞান পূর্বধারণামূলক বৌদ্ধিক উপলব্ধি বা আপ্তজ্ঞান বা এমনকি কমনসেন্সের শাসনে না থাকুক। এটা হয়ে উঠুক স্বাধীন, সার্বভৌম ও মুহুর্মুহু পুনঃপুনঃ লাগাতার নিরন্তর পরীক্ষা বা তদন্তনির্ভর। আধুনিক কালে মোটের ওপর সামাজিক গবেষণা সেই কাজটাই করে থাকে।’

‘ঐতিহ্য’ আমাদের অনুভূতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শব্দ। মোটামুটি স্পর্শকাতরও বটে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাখরখানিকে উদাহরণ ধরে রচিত হয়েছে ‘কীভাবে ঐতিহ্যরা হারিয়ে যায়?’। এই বিলুপ্ত কাহন বর্ণনা কারার পর তা সংরক্ষণবিষয়ক একটি আলোচনার তাড়না থেকেই বাংলায় বহুল প্রচলিত আরেক খাদ্যবস্তু ঝালমুড়িকে উদাহরণ হিসেবে ধরে দেখিয়েছেন ‘কীভাবে ঐতিহ্য’ সংরক্ষিত হতে পারে?’ এই ব্যাপারগুলোতে যে উদ্যোক্তাদের চরিত্র-ব্যক্তিত্ব-সামর্থ্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ, সহজেই সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়। ‘আইনের শাসন বলতে কী বুঝবেন?’ এবং ‘স্মাগলার চিনবেন কীভাবে?’ শিরোনামের রচনা দুটিতেও দারুণ দারুণ সব উদাহরণ ব্যবহার করে জটিলসব বিষয়কে নিমিষেই সহজবোধ্য করে তোলা হয়েছে।

‘(সামাজিক) শ্রেণি অনুধাবন বা পাঠের সমস্যা কি?’ বিষয়ক রচনা ছয়টির শিরোনামগুলো হচ্ছে, ‘শ্রেণি অনুধাবন বা পাঠের সমস্যা কি?’, ‘উপযোগ আর ব্রান্ডবাদিতার ভেজাল’, ‘স্থাবর/উত্তরাধিকার আর চাকরি গুলিয়ে ফেলা’, ‘গরিবের পেশা নিয়ে বিচিত্র সব প্রপাগান্ডা’, ‘উন্নত শহরে অদৃশ্য গরিবেরা’, ‘সচ্ছল প্রবাসীর দেশপ্রেম বিষয়ে আপনার বোঝাবুঝি’। শ্রেণি বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ স্বরূপ পুলুয়া-হালুয়ার বাসনার সবিস্তার বিশ্লেষণ উপস্থাপনের পর লেখক বলেছেন, ‘যার উদরপূর্তি নিয়মিত ঘটে তিনি এক শ্রেণি, যাঁর বাসনা ভেসে বেড়ায় তিনি আরেক শ্রেণি।’

স্থাবর/উত্তরাধিকার আর চাকরি গুলিয়ে ফেলা বোঝাতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে টেনে আনেন, নির্বাচনের আগে সহায়-সম্পদের বিবরণীর বিষয়। তারপর অনেকটা ব্যাঙ্গাত্মক ভাবেই লেখক বলেন, ‘যে সম্পদ বাড়ানোর জন্য তাঁরা জীবন-যৌবন-আইনকানুন সব জলাঞ্জলি দিলেন, সেগুলো লুকানোর জন্য তাদের ব্যতিব্যস্ততা দেখে হয়তো আমাদের একটা প্রতিহিংসামূলক আনন্দ হয়ে থাকে।’ গরিবের পেশা নিয়ে বিচিত্র সব প্রপাগান্ডার কথা পাড়তে গিয়ে লেখকের অভিব্যক্তি উঠে আসে, ‘আমার ধারণা মানুষের মাথায় এত ঘিলু যে, যে-যার মতো করে ভাবনার দুনিয়া বানানোর পরেই অন্যদের কথাবার্তা পড়েন।’ পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী কথাটি ভীষণ সত্য। অনেক সমস্যা সৃষ্টির কারণও বৈকি! পরিস্থিতি, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাব সমত আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ভেদাভেদের এক চমৎকার উদাহরণ দেওয়া হয়েছে গরিবের পেশা নিয়ে বিচিত্র প্রোপাগান্ডায়। পর্যটকীয় চোখে দেখবার কালে যেন ছোট লোকদের ঢেকেঢুকে রাখতে পারাই বড় শহর হয়ে উঠবার প্রধান শর্ত।

আপনাদের অতিশয় জটিল ফোকপ্রীতি অনুধাবন প্রসঙ্গে তিনটি রচনা রয়েছে এখানে। যথা ‘কাকে বলবেন ফোক?’, ‘ফোক দখল করবেন কীভাবে?’, ‘ফোকের মালিকানা নিয়ে যত ভেজাল’। বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিদ্যাধারা, অনুষদে অন্তর্ভুক্তি আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে ‘সর্বত মঙ্গল রাধে’ কিংবা ‘আইলারে নয়া দামান/জামাই’ এর মতো ভাইরাল ব্যাপারগুলোকেই যখন উদাহরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে, তখন এ বিষয়গুলো যে অতি সাধারণ পাঠকের কাছেও অতি সহজেই বোধগম্য হয়ে উঠছে, তা বলাই যায়। লোকশিল্পের মালিকানা নিয়ে মাঝেমধ্যে যে বিতর্কগুলো সামনে আসে সে-সম্পর্কেও লেখক নিজের কনসেপ্ট ক্লিয়ার করেছেন। আপনাদের লিঙ্গ অনুধাবন প্রসঙ্গে রচনা তিনটি হলো যথাক্রমে- ‘যেসব কারণে জেন্ডার-এর বাংলা গণ্ডার করা যেতে পারে’, ‘কনসেন্ট বিষয়ে সহজে বুঝবেন কীভাবে?’, ‘এত রকম নারীবাদ কেন?...এত মহলের বিদ্বেষ কেন?’। আর আপনাদের অনুভূতির কাঠামো প্রসঙ্গে সর্বশেষ লেখাটি হচ্ছে, ‘সাইবার আমলে হিংসা-বিদ্বেষ-রাগ কি বেড়েছে?’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃবিজ্ঞান বিভাগে পড়ান লেখক মানস চৌধুরী। নানা ভঙ্গিতে এবং নানা ফোরামে রচনা করেছেন। পেশাগত জীবনে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আর শ্লেষাত্মক রচনার তাগিদে আমাদের আশপাশের নিত্য ঘটনাবলি যে তাঁর কলমে সত্যিকারার্থেই সরল সমাজপাঠ হিসেবে ধরা দিয়েছে, বইটি শেষ করার পর সেকথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বইটিকে মানস চৌধুরীর একটি শ্লেষাত্মক রচনা সংকলন হিসেবেই অবিহিত করা যায়।

বই: সরল সমাজপাঠ
লেখক: মানস চৌধুরী
প্রথম সাইবার প্রকাশ: ৩১ডিসেম্বর ২০২২; বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, ঢাবি সংসদ।
প্রথম প্রকাশ: এপ্রিল ২০২৩; চৈত্র ১৪২৯
প্রকাশক: গ্রন্থিক প্রকাশন
প্রচ্ছদ: জাহিদ জামিল-এর অঙ্কিত ছবি অবলম্বনে রাজ্জাক রুবেল
পৃষ্ঠা: ১৩৬
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০৳