শরতের সন্ধ্যা

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

সন্ধ্যায় চা খেতে বের হয়ে দেখি অনিমেষ কলেজের পুকুরপাড়ে বসে আছে। গুনগুন করে নিজের সঙ্গে কথা বলছে। পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষ কারও সঙ্গে কথা না বলার যন্ত্রণা কমাতে নিজের সঙ্গে কথা বলে। ক্যানটিনে খেতে গেলেই অনিমেষের সঙ্গে দেখা হয়। কোনার দিকটায় প্লেটে একটি শিঙাড়া নিয়ে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে কী যেন ভাবে! আর কিছুক্ষণ পরপর পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দেখে।

এই অদ্ভুত দুনিয়ায় নানান কিসিমের মানুষের দেখা মেলে। কেউ হাসে, কেউ কাঁদে। কিছু মানুষ মন খুলে হাসতেও পারে না, আবার চিৎকার করে কাঁদতেও পারে না। এই ধরনের মানুষের যন্ত্রণা সবচেয়ে বেশি। যন্ত্রণায় তারা ছটফট করে; অথচ প্রকাশ করতে পারে না। ক্যানটিনের কোনার জায়গাটাই কেন অনিমেষের পছন্দ, জানি না। রোজ একই ধরনের খাবার অর্ডার করে সে। দুটি তেল ছাড়া পরোটা, সঙ্গে মুগডাল। মানিব্যাগে আছে বাইশ টাকা। এক কাপ চা-ও হয়ে যাবে।

অনিমেষের ভারি কথায় আশ্চর্য হই! ওর হাসি দেখি। সহজ-সরল মানুষেরা আজীবন মানুষকে ভালোবেসে যায়, ভালোবাসা পায় না। সে ইতস্তত ভঙ্গিমায় বলে, ‘বেয়াদবি না নিলে চায়ের বিলটা আজ আমি দিতে চাই ভাই। আমার খুব শখ আপনাকে একদিন চা খাওয়াব।’

অনিমেষকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভালো আছিস?’

অপ্রস্তুত হয়ে সে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম ভাই। চলছে। আপনি ভালো?’

হ্যাঁ–সূচক জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘তোর বাবার শরীর কেমন?’

অনিমেষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর নিচে তাকায়। একটু হেসে বলে, ‘আব্বা নেই ভাইজান। একদিন ভোরে উঠে দেখলাম উনি নড়াচড়া করছেন না। ডাকলাম বেশ কয়েকবার। জবাব দিলেন না। লোকজন ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এসে বলল, ভদ্রলোক নেই। শেষবারের মতো সাদা কাপড় গায়ে জড়িয়ে আব্বাজান সেই যে চলে গেলেন, আর আসেননি!’

কোনো জবাব দিতে পারলাম না। বললাম, ‘আচ্ছা নাশতা কর। সন্ধ্যায় দেখা হবে।’

‘আচ্ছা ভাই।’ সে হাসিমুখে জবাব দেয়।

সন্ধ্যায় কালু মামার দোকানে চা খেতে গিয়ে দেখি অনিমেষ বসে আছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাই, কলেজ তো ছুটি দিল। বাড়িতে যাবেন না?’

‘যাব। তুই যাবি না?’ বসতে বসতে জবাব দিলাম।

‘জি ভাই। আজ রাতের ট্রেনে।’

‘চা খাবি?’

‘খাওয়া যায়। পৃথিবীতে চায়ের আমন্ত্রণ ফেরাতে নেই। যারা চায়ের আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেয়, তারা অনেকটা পাষাণ প্রকৃতির মানুষ! আমি নিশ্চয়ই কঠিন প্রকৃতির মানুষ নই, আপনি জানেন।’ হেসে ফেলে সে।

অনিমেষের ভারি কথায় আশ্চর্য হই! ওর হাসি দেখি। সহজ-সরল মানুষেরা আজীবন মানুষকে ভালোবেসে যায়, ভালোবাসা পায় না। সে ইতস্তত ভঙ্গিমায় বলে, ‘বেয়াদবি না নিলে চায়ের বিলটা আজ আমি দিতে চাই ভাই। আমার খুব শখ আপনাকে একদিন চা খাওয়াব।’

আমি হেসে বলি, ‘বড়দের সামনে ছোটদের বিল দেওয়া নিষেধ। এটি অলিখিত নিয়ম।’

অনিমেষ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। একটু থেমে বলে, ‘ভাইজান, আরেক কাপ চা খাবেন? ক্ষুধা চলে যাবে। রাতের মিল পঁয়ত্রিশ টাকা। দুইটা চা ১০ টাকা। ২৫ টাকা সাশ্রয়!’

আজ বিকেলের দিকে বৃষ্টি হয়েছে। শান্ত পরিবেশ। গাছের পাতাগুলো থেকে টিপ টিপ করে কিছুক্ষণ পরপর পানি পড়ছে। সন্ধ্যার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখলাম অনিমেষের চোখে পানি।

‘ভাইজান, একটু জড়িয়ে ধরি আপনাকে?’ সে জর্জরিত কণ্ঠে বলে।

আমি কিছু বলতে পারি না। সে কী মনে করে প্রায়ই এমন পাগলামি করে, জানি না।

মাসের শেষ দিন আজ। পকেটের এদিক–ওদিক খুঁজে দেখলাম কিছু খুচরা পয়সা আছে। তিনটা তেল ছাড়া পরোটা, সঙ্গে ডালভাজি ও একটা চা। আজ দিব্যি চলে যাবে। শরতের সন্ধ্যায় আকাশের দিকে তাকিয়ে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে। পুকুরপাড়ে বসে একটা পাথরের টুকরা ছুড়ে ফেলে লক্ষ করলাম, পাথরটা ডুবে গেল। আর উঠে এল না। অনেকটা মানুষের জীবনের মতো। মানুষ একবার চলে গেলে ফিরে আসে না। অবনীতাও আসেনি। ফিরে আসার জন্য মানুষের জন্ম হয়নি। মানুষের জন্ম হয়েছে চলে যাওয়ার জন্য।

অনিমেষ পুকুরের অন্য পাশের বেঞ্চটিতে শুয়ে সোজা আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা