গ্রামের শেষ মাথায় নিঃশব্দ এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে কৃষ্ণচূড়াগাছটি। বৈশাখ এলেই ডালে ডালে আগুনরঙা ফুল ফোটে, ঠিক যেমন ইরার হাসি। গাছটার নিচে প্রতিদিন এসে বসে কাব্য। পাশে থাকে না কেউ, শুধু একটুখানি শূন্যতা আর ইরার স্মৃতি।
ইরার মুখে ছিল চুপচাপ সৌন্দর্য। একরাশ ঘ্রাণ ওর চুলের, যেন হালকা আতরের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা কাশফুল মিশে গেছে। আর চোখে? চোখে ছিল এক চিরন্তন প্রশ্ন, তুই কি আমায় ভালোবাসিস?
কাব্য কিছু বলত না। কেবল চোখে ভাসিয়ে দিত একরাশ কবিতা, যা কেবল ইরা পড়তে পারত।
তারপর একদিন ইরা নিঃশব্দে হারিয়ে গেল। শুধু রেখে গেল একটা কথা, ‘আমি যদি কোনো দিন চলে যাই, এই গাছটার নিচে অপেক্ষা করিস। আমি ফিরলে, তোকে সবার আগে দেখতে চাইব।’
সেই থেকে কাব্য প্রতিদিন আসে কৃষ্ণচূড়াগাছটির নিচে।
ফাল্গুনের শেষ দিন। হালকা রোদের ভেতর হঠাৎ কাব্য শুনল একটা মৃদু কান্নার আওয়াজ। গাছের গোড়ার পাশে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল একটা ছোট কুকুরছানা। শরীরে কাদা, চোখে ভয়। পালায়নি, শুধু কাঁপছিল। কাব্য ধীরে কাছে গিয়ে হাত বাড়াল। কুকুরছানাটি কাঁপতে কাঁপতে তার কোলে উঠল। নিজের চাদর মুড়িয়ে নিল। নাম রাখল টমি। সাদা-কালো গায়ের রঙে নামটা হুট করেই এসেছিল, যেন আগে থেকেই ঠিক ছিল। তারপর থেকে কাব্য আর একা নয়।
গোধূলি নামে, বৃষ্টি পড়ছে। টমি গা ঘেঁষে থাকে। দুজন বসে থাকে গাছের নিচে। কাব্যের চোখে একটিই কথা, ‘তুই যদি একবার আসতি ইরা, আমি বুঝতাম, আমার প্রতীক্ষা বৃথা যায়নি। কিন্তু তুই এলি না। কেন এলি না, ইরা!’
কুকুরছানা মুখ গুঁজে দেয় কাব্যের গায়ে। বোঝে হয়তো, আবার বোঝেও না।
সাত বছর পর। গ্রীষ্মের দিন, আকাশ গম্ভীর। বৃষ্টি নামবে। কাব্য চুপচাপ বসে থাকে, পাশে টমি। তার কণ্ঠে ভেসে আসে শান্ত অথচ বিষণ্ন একটা সুর—
‘ডাক্তার বলেছে, আর বেশি দিন নেই, টমি।
তুই দেখিস যদি ও আসে, আমার কথা বলিস।
বলিস ওর নামটাই ছিল আমার শেষ শব্দ।’
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামে। ঝোড়ো হাওয়ায় পড়তে থাকে গাছের পাতা। গোধূলি নামার সঙ্গে সঙ্গে কাব্য ফিরে যায় বাসায়।
পরদিন সকালে গাছটার নিচে কাব্য আর আসে না। শুধু টমি শুয়ে থাকে একা। চোখে অভিমান আর অপেক্ষা।
তিন সপ্তাহ পর। ইরা ফিরে আসে। হাতে কাব্যের পুরোনো কবিতার খাতা। গাছের নিচে কুকুরটি চুপচাপ শুয়ে আছে। সে মাথায় হাত রাখতেই কুকুরটা মুখ গুঁজে দেয় তার গায়ে। একটা কৃষ্ণচূড়া ফুল পড়ে খাতার ওপর। শেষ পাতায় লেখা—
‘তুই আসবি, কি আসবি না, আমি জানি না। তবু আমি থাকব এখানে, যতক্ষণ না চোখ চিরতরে বন্ধ হয়।’
ইরার চোখ ভিজে ওঠে। আকাশ বৃষ্টি নামায় ধীরে, যেন অশ্রু মেশানো এক বর্ষা। সে চুপ করে বসে থাকে গাছের নিচে। ঠিক তখনই এক দমকা হাওয়া বয়ে যায়, ইরার ভেতরের শূন্যতাকে স্পর্শ করে।
অপেক্ষা রয়ে যায়...কৃষ্ণচূড়ার নিচে।
সহসভাপতি, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা