বিসর্জন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাতে একটা ২০০ টাকার নোট, তিনটা ১০০ টাকার নোট আর দুইটা ৫০ টাকার নোট—সব মিলিয়ে ৬০০ টাকা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন নগেশ বর্মণ। অনেক অনুনয়–বিনয়ও করলেন। কিন্তু পূজা কমিটির লোকেরা সেই টাকা নিলেন না। পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিলেন, এবার প্রতিটি পরিবার থেকে হাজার টাকার কমে কোনো চাঁদা নেওয়া হবে না। কারণ, পূজার উপকরণ থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বাড়তি। তাই পরিবারপ্রতি পূজার চাঁদার পরিমাণও বাড়ানো হয়েছে।

পূজা কমিটি সবার সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই বছর যে পরিবার পূজার চাঁদা হিসেবে হাজার টাকা দিতে পারবে না, সেই পরিবারকে পূজা দিতেও দেবে না। পাশাপাশি সমাজ থেকেও আলাদা করে দেওয়া হবে। মানে সমাজচ্যুত করা হবে। পূজা কমিটির লোকের মুখ থেকে এমন সব কঠিন কঠিন কথা শুনে তিনি কোনো প্রতিবাদই করলেন না। শুধু মাথা নিচু করে সব শুনলেন। তারপর নীরবে জায়গাটি থেকে প্রস্থান করলেন। দুর্গাপূজা শুরু হতে তখনো দিন তিনেক বাকি। এরই মধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছেন পূজার চাঁদা দেওয়ার। কিন্তু টাকার অঙ্ক কম দেখে পূজা কমিটির লোকেরা তা গ্রহণ করলেন না।

প্রতি সপ্তাহে ৩০০ টাকা করে বড় মেয়ের বিয়ের সময় এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি শোধ করে, নিজের চিকিৎসা আর সংসারের খরচ সামলিয়ে এই মুহূর্তে হাজার টাকা জোগাড় করা তাঁর জন্য বড্ড কঠিন হয়ে পড়েছে।

এক মেয়ে, এক ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে নগেশ বর্মণের চার সদস্যের পরিবার। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বছর তিনেক হতে চলল। মেয়ের কোল আলো করে এসেছে ফুটফুটে এক পরি। মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরাও অনেক ভালো। আদর–যত্নের কোনো কমতি রাখেন না মেয়ের। অবশ্য একটি কারণও আছে। বড় মেয়ের বিয়ের সময় বরপক্ষ পণ হিসেবে লাখ টাকা চেয়েছিল। নগেশ বর্মণ এক এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের শ্বশুরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সেই টাকা। সবাই বলে শ্বশুরবাড়ির আদর-যত্নের পেছনে এই লাখ টাকার অবদান নাকি অনেক বেশি। নগেশ বর্মণের ছোট ছেলে নবম শ্রেণিতে পড়ছে পাশের মিশনারি স্কুলে।

পেশায় নগেশ বর্মণ একজন শিলপাটা তৈরির কারিগর। পাথর খোদাই করে এই শিলপাটা তৈরি করা হয়। মসলা গুঁড়া করার সবচেয়ে প্রাচীন পদ্ধতি হিসেবে শিলপাটার কদর অনেক বেশি। একটি পাটা আর শিল কেটে সম্পূর্ণ করতে পারলে ৩০ টাকা করে পাওয়া যায়। জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে রোজ সাত থেকে আটটির বেশি শিলপাটা তৈরি করতে পারেন না নগেশ বর্মণ। কিশোর বয়সে বাবার হাত ধরে যখন এই পেশার হাতেখড়ি হলো, তখন দিনে ১৫টির মতো শিলপাটা তৈরি করতে পারতেন। এখন হাঁপানি আর বয়সের কারণে খুব একটা কুলিয়ে উঠতে পারেন না। তা ছাড়া বাপ-দাদার আমলের পেশা ছেড়ে যে অন্য পেশা বেছে নেবেন, সেই সুযোগটিও নেই। নগেশ বর্মণের পূর্বপুরুষেরা যে হাতুড়ি আর ছেনির সাহায্যে শিলপাটা খোদাইয়ের কাজ করতেন, বংশপরম্পরায় এখন তিনি সেগুলোর মালিক। বাপ-দাদার আমলের হাতুড়ি-ছেনি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে তাঁর মনে আর্দ্রতা নেমে আসে। মনে হয়, এই তো সেদিন বাবা তাঁকে হাত ধরে কাজ শিখিয়ে দিচ্ছেন। সারা দিন কাজ করে যা পান, সন্ধ্যায় ওসব নিয়ে বাড়ি ফেরেন তিনি। প্রতিদিন ওসব দিয়ে চলে তাঁর তিন সদস্যের সংসার। সেই সংসারে কোনো সময় হাসি থাকে আবার কোনো সময় দুঃখের মধ্যেও সুখের অনুভূতি খোঁজার চেষ্টা চলে।

প্রতিদিন যে আয়টুকু হয়, ওখান থেকে একটু একটু সঞ্চয় করে তিনি দুর্গাপূজার জন্য চাঁদা জমিয়েছেন। অল্প অল্প করে জমতে জমতে সেটা এখন ৬০০ টাকায় এসে ঠেকেছে। গতবারের পূজায় তিনি চাঁদা দিয়েছিলেন ৫০০ টাকা। এবারও মনে করেছিলেন ৫০০ টাকার আশপাশেই হয়তো চাঁদা দিতে হবে। তাই ওভাবেই হিসাব করে সঞ্চয় করেছেন ৬০০ টাকা। কিন্তু এবার চাঁদার পরিমাণ দ্বিগুণ করা হয়েছে। প্রতি সপ্তাহে ৩০০ টাকা করে বড় মেয়ের বিয়ের সময় এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি শোধ করে, নিজের চিকিৎসা আর সংসারের খরচ সামলিয়ে এই মুহূর্তে হাজার টাকা জোগাড় করা তাঁর জন্য বড্ড কঠিন হয়ে পড়েছে। যদি পূজা শুরু হতে আর মাস দেড়েক বাকি থাকত, তখন হয়তো কোনো একটা ব্যবস্থা করা যেত। এখন সেই সুযোগও নেই।

দেখতে দেখতে দুর্গাপূজা এসে গেল। কারুকার্য করে পূজার গেট তৈরি করা হলো। রঙিন প্যান্ডেলে প্রতিমা বসানো হলো। পুরোহিতের মন্ত্রপাঠও যাতে এই পাড়া পেরিয়ে অন্য পাড়ায় শোনা যায়, তার জন্য তিনটি বড় বড় মাইকও বসানো হলো। চারপাশে আলোর ঝিকিমিকি। সাজসাজ রব উঠেছে পাড়ায় পাড়ায়। নগেশ বর্মণ পাড়ার কোনো একজন থেকে বলেকয়ে ১০০ টাকা ধার করে ষষ্ঠীপূজার সময় ৬০০ টাকার সঙ্গে সেই ১০০ টাকাও যোগ করে মোট ৭০০ টাকা নিয়ে হাজির হলেন পূজা কমিটির লোকের সামনে। এবারও পূজা কমিটির লোকেরা টাকার অঙ্কে ৩০০ টাকা কম দেখে তাঁর কাছ থেকে চাঁদা নিলেন না। উল্টো তাঁকে দুয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করলেন না। পূজা কমিটির লোকদের মুখ থেকে এমন সব কথা শুনে তিনি মুখটা তুলে একটিবারের জন্যও প্রতিবাদ করলেন না। অষ্টমীর সময় দেখা গেল পাড়ার কচিকাঁচা থেকে বয়োবৃদ্ধ সবাই ঠাকুরের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতে এসেছেন। প্রতিটি পরিবার থেকে থালায় ভর্তি করে নৈবেদ্য সাজিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু নগেশ বর্মণের পরিবার থেকে কোনো নৈবেদ্য আনা হয়নি। আর ঠাকুরের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দিতেও কেউ আসেননি। যদি পূজা কমিটির লোকেরা কিছু একটা বলে বসেন এই ভয়ে। নগেশ বর্মণের আত্মসম্মানবোধ প্রবল। তিনি দুই বেলা না খেয়ে উপোস থাকতে পারবেন কিন্তু মানুষের কাছে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিতে পারবেন না।

নবমীর দিন সকালে নগেশ বর্মণ হাতুড়ি-ছেনির থলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পণ করলেন আজ যেভাবে হোক চাঁদার হাজার টাকা জোগাড় করে পূজা কমিটির লোকের হাতে দিয়ে আসবেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আবছা অন্ধকারে তিনি ঘর্মাক্ত শরীরে দুই কেজি চাউল, ১০ টাকার কাঁচা মরিচ, সঙ্গে আধা কেজি আলু নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সেদিন ঘরের সব খরচ বাদ দিয়ে তিনি দেখলেন, তাঁর কাছে আর মাত্র ২০০ টাকা অবশিষ্ট আছে, যা হাজার টাকা থেকে আরও ১০০ টাকা কম। বিসর্জনের দিন পুরোহিত শেষ মন্ত্রটি পাঠ করলেন। দেবীর বিদায়ের সুর বেজে উঠল। নগেশ বর্মণ মাইকে তা স্পষ্ট শুনলেন। সবাই দুর্গা ঠাকুরের চরণে শেষবারের মতো পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন করলেন। আবিরে রাঙিয়ে দিলেন ঠাকুরের দুই চরণ। নগেশ বর্মণ কিঞ্চিৎ দুর্গা প্রতিমার দিকে তাকিয়ে নীরবে দুই ফোঁটা চোখের জল ফেললেন। তারপর হাতুড়ি-ছেনির থলে নিয়ে প্রতিদিনকার মতো বেরিয়ে পড়লেন আগামী বছরের জন্য পূজার চাঁদা হাজার টাকা জোগাড় করার উদ্দেশ্যে। না হলে যে তাঁর পরিবারকে টানা দুই বছর সমাজচ্যুতের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে।

সদর, কক্সবাজার