তিতলির আজ মন খারাপ। খুব বেশি মন খারাপ হলে সে শাড়ি পরে লেকের পাড়ে এসে বসে থাকে। পানিতে পা ভেজায়। কাগজের নৌকা বানিয়ে লেকের পানিতে ভাসিয়ে দেয়। সেগুলো ভাসতে ভাসতে একটা সময় পানিতে তলিয়ে যায়। আজকেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। একা বসে নৌকা ভাসাচ্ছে সে।
নৌকা ভাসানো দেখে অনিমের নজর তিতলির দিকে যায়। একটা শাড়ি পরা তরুণী এই ভরদুপুরে কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসাচ্ছে। সে উপভোগ করছে ব্যাপারটা। কয়েকটা নৌকা ভাসানোর পর কাগজ শেষ। ব্যাগে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর কাগজ পেল না মেয়েটা। এক টুকরা ছেঁড়া কাগজ চরম বিরক্তিতে পানিতে ছুড়ে মারে সে। অনিমের কাছেও ব্যাপারটা খারাপ লাগে।
ঘটনা দেখে অনিম কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে সেখান থেকে উঠে চলে যায়। তিতলি জায়গাতেই বসে থাকে। ভাসিয়ে দেওয়া নৌকাগুলোকে দেখতে থাকে। বেশ খানিকটা পথ হাঁটার পর একটা দোকান খুঁজে পায় অনিম। পকেটের সর্বস্ব দিয়ে ১৮টা রঙিন কাগজ নিয়ে লেকের দিকে পা বাড়ায়। এতক্ষণে ইন্টারভিউ বোর্ডে অপমানিত হওয়ার ঘটনা সবকিছু ভুলে গেছে।
—‘এই নিন কাগজ।’ কিছুটা হতভম্ভই হয়ে তাকায় তিতলি। জিজ্ঞেস করে, ‘মানে? এগুলো কেন? কে আপনি?’ আমাকে চিনবেন না। হাত দিয়ে বসে থাকার জায়গাটা দেখিয়ে বলে, ওইখানেই বসে ছিলাম।
একটা ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম। এবারও চাকরি হবে না। আপনার নৌকা দেখে আমার সব বিষণ্ণতা দূর হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার কাগজ শেষ হওয়া দেখে খারাপ লাগল। তাই কাগজ কিনে আনলাম। তিতলি অনিমের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলাল। যেই লোক পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে যায়, সে যে উজবুক মানুষ, সেটা তিতলি বুঝে গেছে। ধমক দিতে মন চাইলেও সেটা করতে ইচ্ছা করছে না।
‘পাঞ্জাবি পরে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন?’ তিতলি কঠিন মুখেও হাসি আটকে রাখতে পারল না। বলল, ‘এই বেশে দেখে নিশ্চয়ই বের করে দিয়েছে আপনাকে?’ অনিম বলে, ‘আপত্তি না থাকলে চলেন নৌকা বানিয়ে ভাসাই। তারপর সব খুলে বলা যাবে।’ জি আচ্ছা!
বসার পর অনিম নিজের গল্প বলার পাশাপাশি কাগজগুলো মাঝখানে ভাঁজ করে দুই ভাগ করে দিচ্ছে। তিতলি সুনিপুণ হাতে সেগুলো দিয়ে নৌকা বানিয়ে পাশে রাখছে। পাশাপাশি অনিমের গল্প শুনছে। দুজনের মধ্যে অপরিচিত ভাবটা কেটে গেছে ইতিমধ্যে।
ইন্টারভিউ দিতে দিতে পায়ের জুতা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, তবু চাকরি মিলছে না। আজকে ৩৩তম ইন্টারভিউ ছিল। ৩৩ আমার জন্য লাকি সংখ্যা। তাই পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলাম। খানিকটা আতরও লাগিয়েছি। বিশুদ্ধতার প্রতীক। আতরের কথা শুনে তিতলি আবার তার দিকে তাকাল।
—আতর! আপনাকে উজবুক মানুষ ভেবেছিলাম। আপনি তো দেখছি মহা উজবুক।
তবে পাঞ্জাবি পরে গেলে বাজে পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে, সেটা আগেই বুঝেছিলাম। তাই খুব একটা দুঃখ হয়নি। তিতলি আবার নৌকা বানানোতে মন দিল।
আপনি ভাবতে পারেন সেখানে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। প্রশ্নকর্তা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলে, ‘আমরা তো কোনো কবি নিয়োগ দিচ্ছি না। আপনি মনে হয় ভুল জায়গায় এসেছেন।’ গল্প বলার পাশাপাশি তিতলির প্রতিও চোখ রাখছে অনিম। মেয়েটা সত্যিই সুন্দর করে নৌকা বানাতে পারে। অবশ্য তাকে এই ব্যাপারটাই তিতলির প্রতি মনোযোগ কাড়তে বাধ্য করেছে।
নৌকা বানানো শেষ হলে দুজনে মিলে সেগুলো একটা একটা করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়। উদ্দেশ্যহীনভাবে দিগ্ভ্রান্ত নৌকারা ছুটে যাচ্ছে একেকটা একেক দিকে। একটা সময় সেখান থেকে উঠে তারাও উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে লাগল। ঠিক উদ্দেশ্যহীন বলা যাবে না। কাগজের নৌকার গন্তব্য না থাকলেও মানুষের গন্তব্য থাকে। দিন শেষে কোথাও না কোথাও আশ্রয় নিতে হয়। ঘরে ফিরে যায়।
তিতলি হঠাৎ অনিমকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমাকে ইমপ্রেস করার জন্য আবার এসব গল্প পাতাচ্ছেন না তো? আপনার মতন মানুষদের আমার চেনা আছে। উদ্ভট উদ্ভট কথা বলে সহজে মেয়েদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন।’ ‘একদম না। বরং আপনি নৌকা বানিয়ে, পানিতে ভাসিয়ে আমার দৃষ্টি কেড়েছেন।’ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে অনিম পাঞ্জাবির পকেট থেকে ইন্টারভিউ দেওয়ার কাগজটা দেখায়। তিতলিও নিশ্চিত হওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে পরখ করে দেখে। তবে আপনার বোধ হয় মন খারাপ। তিতলি কোনো উত্তর দেয় না। চুপচাপ সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। অনিম তিতলির প্রস্থানের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাবেক সহসভাপতি, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা