সন্তানের মূল্যবোধ তৈরিতে মা–বাবার ভূমিকা

সন্তানের বেড়ে ওঠা থেকে তাদের ভবিষ্যতের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে মা-বাবার ওপরমডেল: রওনক হোসেন, শুভ ও উল্কা হোসেন। ছবি: প্রথম আলো

সন্তানের মূল্যবোধ তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে সুন্দর করতে সাহায্য করে। মূল্যবোধ হলো সেই আদর্শ, যা একজন ব্যক্তি জীবনের বিভিন্ন দিক থেকে গ্রহণ করে। এটি তাকে সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। সন্তানের মূল্যবোধ তৈরি করা মানে তাদের মধ্যে নৈতিকতা, সততা, দায়িত্ববোধ, সম্মানবোধ, সহানুভূতি ও পরিশ্রমের মতো গুণাবলি বিকাশ করা।

মূল্যবোধ তৈরি প্রয়োজন কেন
একটি সমাজের ভিত্তি হলো মূল্যবোধ। এটি ব্যক্তির আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জীবনযাপনে প্রতিফলিত হয়। সঠিক মূল্যবোধ না থাকলে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অপরাধ ও অরাজকতার পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে। তা ছাড়া মূল্যবোধ একজন ব্যক্তিকে সঠিক পথ নির্দেশ করে, তাকে জীবনে উন্নতির পথে পরিচালিত করে। এ জন্য সন্তানদের মধ্যে শৈশব থেকেই সঠিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা জরুরি।

যেভাবে সন্তানের মধ্যে মূল্যবোধ তৈরি করবেন
মূল্যবোধ তৈরি করা একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, যা বিভিন্ন উপায়ে করা যায়। যেমন সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরি করতে পারিবারিক পরিবেশের ভূমিকা অপরিসীম। মা–বাবা, পরিবার, কাছের আত্মীয়স্বজনের আচরণ ও মূল্যবোধ সন্তানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। পরিবারের বড়দের মধ্যে যদি সত্যবাদিতা, দায়িত্ববোধ ও সম্মানবোধ থাকে, তাহলে সন্তানেরাও এসব গুণ নিজেদের মধ্যে বিকশিত করার চেষ্টা করে।

মূল্যবোধ চর্চায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, এটি নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের মতো গুণাবলি গড়ে তোলা। এ ছাড়া স্কুলে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সহানুভূতি, সহযোগিতা ও পরিশ্রমের মানসিকতা গড়ে তোলা যায়।

যে বিষয়টি আমাদের মধ্যে এখন সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা যায়, সেটি হলো ধর্মীয় শিক্ষার অভাব। ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি সঠিক ও ভুলের পার্থক্য বুঝতে শেখে। ধর্মীয় অনুশাসন, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার শিক্ষা একজন সন্তানের জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপাসনালয় ও ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে সন্তানদের মধ্যে বিশ্বাস, সততা ও সহানুভূতির মানসিকতা তৈরি করতে হবে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা সমাজে বসবাস করতে গিয়ে করি না, সেটা হলো সন্তানের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন। সন্তানদের মূল্যবোধ তৈরি করতে সমাজের সঙ্গে তাদের সংযোগ জরুরি। সমাজের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা এবং বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তারা মূল্যবোধ শেখে। যেমন বয়স্কদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, দুর্বলদের সহায়তা করা, সামাজিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি। এসব কাজের মাধ্যমে সন্তানেরা সামাজিক মূল্যবোধ শেখে এবং সেগুলোকে জীবনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে।

পরিবারে যতটা সম্ভব গল্প করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। গল্প, উপন্যাস ও নীতিকথা শিশুদের মূল্যবোধ শেখানোর একটি অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। বিভিন্ন নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধ নিয়ে লেখা গল্প বা রূপকথা শিশুদের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। এসব গল্পের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার, সহানুভূতি ও সম্মানের মতো গুণাবলি বিকশিত হয়। বাড়িতে এমন কিছু নিয়ম ও রুটিন তৈরি করতে হবে, যা তাদের মূল্যবোধ তৈরির একটি কার্যকর উপায়। যেমন নিয়মিত পড়াশোনা, খেলাধুলা, ঘর গোছানো এবং পরিবারের অন্যান্য কাজে সহায়তা করার মাধ্যমে সন্তানদের দায়িত্ববোধ ও পরিশ্রমের মানসিকতা তৈরি হয়।

মা–বাবা হিসেবে অনেক সময় মনে করি, প্রযুক্তি ব্যবহার একটি অভিশাপ। আসলে ব্যাপারটা সে রকম নয়। আজকের যুগে প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মূল্যবোধ গড়ে তুলতে এবং তা ভঙ্গ করতে—উভয় ক্ষেত্রেই ভূমিকা রাখে। সন্তানকে সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে, যাতে তারা ভুল পথে পরিচালিত না হতে পারে। মা–বাবার উচিত সন্তানের প্রযুক্তির ব্যবহার মনিটর করা এবং তাদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার শেখানো। শিশুদের জন্য নিরাপদ ও শিক্ষামূলক কনটেন্টের ব্যবস্থা করা; যাতে তারা সেখান থেকে সঠিক মূল্যবোধ অর্জন করতে পারে।

মা–বাবার ভূমিকা
সন্তানের মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মা–বাবা হলেন প্রধান শিক্ষক। সন্তানেরা সাধারণত মা–বাবার আচরণ, কথা ও কাজকর্ম থেকে মূল্যবোধ শেখে। এ জন্য মা–বাবার উচিত সন্তানের সামনে সব সময় সঠিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

মা–বাবার নিজস্ব আচরণই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানেরা তাঁদের কাজকর্ম ও আচরণ থেকে মূল্যবোধ শেখে। যদি মা–বাবা সত্যবাদী, দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল হন, তবে সন্তানেরাও সেই গুণাবলি গ্রহণ করবে।

সন্তানদের শৈশব থেকে শৃঙ্খলা শেখাতে হবে। শৃঙ্খলা একজন ব্যক্তির জীবনের সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপন শেখানো, সময়মতো কাজ সম্পন্ন করা এবং নিয়ম অনুযায়ী চলার অভ্যাস তৈরি করা তাদের মধ্যে দায়িত্ববোধ ও পরিশ্রমের মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

মা–বাবার ইতিবাচক মনোভাব সন্তানের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। সন্তানের প্রতি সর্বদা ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখা, তাদের সফলতার প্রশংসা করা এবং ভুল করলে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া উচিত। এতে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় এবং তারা ভবিষ্যতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়। সন্তানদের সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথন এবং তাদের চিন্তাভাবনা শেয়ার করার সুযোগ দেওয়া জরুরি। এতে তারা নিজেদের মধ্যে যেকোনো ধরনের দ্বিধা, সংশয় বা উদ্বেগ নিয়ে কথা বলতে পারে। মা–বাবা যদি তাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেন এবং পরামর্শ দেন, তাহলে সন্তান সঠিক পথ অনুসরণ করতে পারে।

শিক্ষক, নোয়াপাড়া ডিগ্রি কলেজ, রাউজান, চট্টগ্রাম ও বন্ধুসভার উপদেষ্টা