লাভলীর তরে মজনুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ‘যাও পাখি বলো তারে’

‘যাও পাখি বলো তারে’ ছবিতে মাহিয়া মাহিছবি: সংগৃহীত
একজন ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা, অনন্ত অপেক্ষা। শূন্য, গভীর জীবন শূন্যতা থেকে পরিপূর্ণের দিকে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়ে এই চলচ্চিত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে।

কৃষ্ণকলি ইসলামের কথা ও সুরে ‘যাও পাখি বলো তারে…’ কোমল নিঠুর বিরহ বেদনার গানটি ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিশ্ব বাঙালির হৃদয় ছুঁয়েছিল। কাঁটাতার দিয়ে মানুষের হৃদয়ের স্রোত কখনো আটকানো যায় না। বিরহী যক্ষ্ম হৃদয়ের বার্তার মতো এই সুরের স্রোত এপার-ওপার দুই বাংলা একাকার করে দিয়েছে। সেই গানের কথার আবেদন এমনই, পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান মানিক ও গানের কথার মূল চাবি অংশটাকে শিরোনাম করে, সুন্দর মিষ্টি একটি বিরহ বেদনাজাত, বিশুদ্ধ প্রেমের ছবি নির্মাণ করে ফেললেন।

আবেগের দেশ বাংলাদেশ। শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্রের মধ্যে আবেগ না থাকলে তা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলে মনেই হয় না। আর মানুষে মানুষে সম্পর্কের আবেগকে অনবদ্য রূপে শিল্পান্তরিত করতে পারেন পরিচালক মানিক; সে তো আমরা ‘দুই নয়নের আলো’ চলচ্চিত্র থেকে দেখে এসেছি।

‘যাও পাখি বলো তারে’ দুই নয়নের আলোর মতো ততটা সৃজনশীল শিল্পের আলোয় আলোকিত না হলেও কোনো অংশে কম কিছুও হয়ে ওঠেনি। অথবা বলা যেতে পারে একজন পরিচালক প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে এসে যদি প্রতিভার শিখর ছোঁয়া ইতিহাস হয়ে ওঠেন, সারাটা জীবন তাঁকে নিজের সঙ্গে নিজের সেই প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হয়। কারণ, আপামর দর্শকের চোখে তিনি দুই নয়নের আলো হয়ে বসে আছেন।

ঠিক একই কারণে ‘যাও পাখি বলো তারে’ শিরোনামের ব্যঞ্জনাও হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে হলে, পুরোনো ভিতের ওপর আরও মনোগ্রাহী কিছু করতে না পারলে মানুষের হৃদয় ছোঁয়া যাবে না। যাকে বলা যায় সৃষ্টির পাশে সৃষ্টির অনন্য লীলা। মহাকালের লীলাধামে স্রষ্টার পাশে স্রষ্টার আত্মিক যোগসূত্রের খেলা। সুদীপ কুমার দীপের কথায় জে কে মজলিশের সুরে চলচ্চিত্রের শীর্ষ সংগীতটি বেলাল খান এবং সায়রা রেজার কণ্ঠে সেদিক থেকে প্রাণ পেয়েছে। লোকসংগীতের টুকরো কথার সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে সুন্দর একটি প্রণয়গীতি। আর ‘যাও পাখি বলো তারে’ এই টুকরো অংশের মাহাত্ম্য সুন্দর ফুটে উঠেছে আসাদ জামানের অনবদ্য কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপে। এই চলচ্চিত্রের অনুভবী সুন্দর সংলাপগুলো চলচ্চিত্রের সম্পদ, চলচ্চিত্রের প্রাণভোমরা।

চিরকালীন প্রণয়গাথার লায়লী-মজনুর মতো এই চলচ্চিত্রে দুই কপোত–কপোতীর নাম হয়েছে লাভলী আর মজনু। লাভলী চরিত্রে মাহিয়া মাহি যখন স্কুটি চালিয়ে যায়, মনে হতে পারত মুম্বাইয়া ঘরানার কোনো হিরোইন। বাংলাদেশের মেঠোপথ, ফলনের খেত, জল, হাওয়া তাকে স্নিগ্ধ লাবণ্যে ভরিয়ে তোলে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার একঝাঁক ‘কইতর’ বা কবুতর উড়ে এসে তাকে খাঁটি বাংলাদেশের মেয়ে করে তোলে। মানিক সিনেমার মতো জীবন গড়ে তুলতে চাননি। বাস্তবতা, আসমান-জমিনের পার্থক্য মাথায় রেখে টুকরা টুকরা গ্রামবাংলার সাধারণ জীবনের ছায়াকে সিনেমায় উত্তীর্ণ করেছেন। আঞ্চলিক ভাষা, মাটির গন্ধ এই চলচ্চিত্রের আবরণ। আর মাহিয়া মাহি, আদর আজাদ, শিফন মিত্র, রাশেদ মামুনুর রহমানরা এই চলচ্চিত্রের আভরণ, অলংকার।

গ্রামের প্রভাবশালী, বিত্তবানের মেয়ে হয়েও লাভলী নিরহংকারী, সাধারণ। গ্রামের চায়ের দোকানি যখন মিষ্টি হেসে, ভালোবেসে আদর করে জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছ মা? লাভলীর প্রাণ জুড়িয়ে যায়। বন্ধুর কাছে নবাব টেইলার্সের কথা জানতে পেরে, মজনুর কাছে এসে মজনুর কাজের মধ্যে সে একজন দক্ষ শিল্পীকে খুঁজে পায়। যেভাবে পৃথিবীর লীলাধামে প্রাণের মানুষের জোড়ি বাঁধা থাকে। অনন্ত অপেক্ষার ভেতর একদিন চার চোখ এক হয়।

মজনু গ্রামের গরিব দরজি। তার বাবা যাত্রাপালার আসরে গান করে বেড়ায়। মানে, শিল্পীর শরীরেও একজন শিল্পীর রক্ত আছে। বাবা বাড়িতে রান্না করে। ছেলের দোকানে গিয়েও মাঝেমধ্যে সাহায্য করে।
মজনু নিজের মন থেকে নিত্যনতুন মেয়েদের পোশাকের ডিজাইন তৈরি করে ফেলতে পারে। কারও দেখানো ডিজাইনও বানিয়ে দিতে পারে। নারী সুন্দর। নারীকে আরও সুন্দরতর করে তুলতে এমন একজন শিল্পীর দরকার। শহুরে নামীদামি ফ্যাশন ডিজাইনারের থেকে কোনো অংশে কম নয় মজনু। আবার খুশি হয়ে ধরাবাঁধা পারিশ্রমিকের অতিরিক্ত কেউ কিছু দিতে চাইলে সে কখনো নেয় না। লাভলীকে প্রথম দেখাতেই মনের মধ্যে পূর্বরাগের ছায়া, ভালোবেসে ফেলে। এই নিখাদ, নীরব, নিঃস্বার্থ ভালোবাসার কথা লাভলী কখনো জানতে পারে না। এই বিশুদ্ধ ভালোবাসার মর্ম যখন বুঝতে পারে, জীবনে তখন অনেক কিছু ঘটে যায়। এভাবে মজনু চরিত্রের মধ্য দিয়ে একজন প্রকৃত শিল্পী এবং একজন মহৎ প্রেমিকের দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন পরিচালক।

ত্রিকোণ প্রেমের গল্পে অন্য এক চরিত্র লাভলীর বাবার ব্যবসায়ী বন্ধুর বিদেশফেরত ছেলে রোমেল। রোমেল দীর্ঘ সময় বিদেশে থেকেও একজন হিটলারের মেয়েকে জীবনসঙ্গী করতে পারেনি। সে লাভলীকে ভালোবাসে। লাভলীও রোমেলকে ভালোবাসে। দুটি বন্ধু পরিবার তাদের বিয়ে দিতে রাজি। কিন্তু উচ্চবিত্তের এই প্রেম পরিণতি পাওয়ার আগে রোমেলদের কারখানায় বহুদিনের অবহেলিত নিম্নবিত্ত শ্রেণির শ্রমিকদের আন্দোলন তেতে গর্জে ওঠে। ভালোবাসার দুয়ারে কড়া নাড়ে অশনিসংকেত।

আঞ্চলিক ভাষা, মাটির গন্ধ এই চলচ্চিত্রের আবরণ। আর মাহিয়া মাহি, আদর আজাদ, শিফন মিত্র, রাশেদ মামুনুর রহমানরা এই চলচ্চিত্রের আভরণ, অলংকার।

শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকে মজনুর প্রাণাধিক বন্ধু শামসু। প্রেম, প্রতিবাদ, বন্ধুত্ব তিনটি বিষয় পাশাপাশি রেখে কাহিনির বিস্তার। মজনু এবং শামসু ছোটবেলা থেকে একটা হাফপ্যান্ট দুজনে পরে পিঠেপিঠি বড় হওয়া বন্ধু। একজন অন্যজনের মনের কথা বুঝতে পারে। সুখে-দুঃখে একজন অন্যজনের পাশে থাকে। কারখানায় মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকপক্ষের তীব্র সংঘাত যখন চরম আকার নেয়, লাঠালাঠিতে পরিণত হয়, রোমেলের লাঠির আঘাতে চিরতরে হারিয়ে যায় শামসু। পুলিশ এসে রোমেলকে ধরে নিয়ে যায়।

লাভলীর মুখের দিকে চেয়ে মজনুর এবার চরম অগ্নিপরীক্ষা। হারিয়ে যাওয়া আপসহীন সংগ্রামী বন্ধু শামসুর হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের পাশে দাঁড়াবে নাকি যাকে নীরবে ভালোবেসে এসেছে, সেই লাভলীর প্রেমিক রোমেলকে কারাদণ্ড থেকে মুক্ত করবে? মালিকপক্ষ টাকা দিয়ে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সব সাক্ষীকে কিনে নেয়। মজনু তো টাকার কাছে কখনো বিক্রি হয় না।

একদিকে বন্ধু, অন্যদিকে মানসী, মজনুর নীরব ভালোবাসা এই পর্যায়ে এসে পৃথিবীর লোভ, লালসা, হিংসা, প্রতিহিংসা, আইন ও বিচারব্যবস্থা সবকিছুকে হারিয়ে দেয়। মানসপ্রতিমা লাভলী তখন বুঝতে পারে, মজনু কত বড় প্রেমিক। অতি অল্প সময়ের জন্য আমরা সবাই পৃথিবীতে আসি। এই অল্প সময়ের জীবনকে অর্থবহ করে রাখার জন্য মজনুর মতো একজন প্রেমিক, ভালোবাসার মানুষ আমাদের প্রত্যেকের জীবনে দরকার।

একজন ভালোবাসার মানুষের জন্য অপেক্ষা, অনন্ত অপেক্ষা। শূন্য, গভীর জীবন শূন্যতা থেকে পরিপূর্ণের দিকে নিয়ে যাওয়ার বার্তা দিয়ে এই চলচ্চিত্রের পরিসমাপ্তি ঘটে। ছবির সুর, সংগীত, চিত্রগ্রহণ, কারিগরি দিক, সবার অভিনয়—সবই সুন্দর। মুস্তাফিজুর রহমান মানিক পাথর কেটে নদী আনতে পারেন। জীবনের গভীরে গিয়ে মণিমানিক্যের সন্ধানে পরিচালক মানিকের এই জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক।

যাও পাখি (গিয়ে) বলো তারে, এই পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলতে মহৎ প্রেমের অনুসন্ধানীদের আমরা কখনো ভুলি না।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত