মা আমার বুনো ফুল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একবার পড়েছিলাম, যেসব মায়ের নাম নদীর নামে হয়, তাঁরা কেউ মেয়েদের ডাকনাম তিতাস রাখেন না। কেন রাখেন না, সে যুক্তিতে এখন যাচ্ছি না। তবে আমার মা তাঁর প্রথম কন্যার নাম রাখতে চেয়েছিলেন মুন, বাংলায় যার অর্থ চাঁদ। সে নাম রাখার ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কন্যাসন্তান জন্মদানের পরে সম্ভবত সব মায়েরই বিভিন্ন রকম অস্বস্তিকর বাধা পেরোতে হয়। তবু নিজের অস্তিত্বকে কন্যার ভেতর কিঞ্চিৎ অনুভব করার যাত্রাটা নিশ্চয়ই চমৎকার।

মায়ের কাছ থেকে আমার বর্তমান দূরত্ব প্রায় ১২ হাজার ৪০ কিলোমিটার। ভিনদেশের এই হিমেল হাওয়ার রাতে ধরা দিচ্ছে শত শত না–বলা গল্প। একবার মায়ের অপারেশন হলো ঢাকায়। আমি সিলেটে বাসায় একা। অপারেশন শেষে যখন মাকে দেখলাম, তখন তিনি ইশারায় কথা বলার চেষ্টা করছেন। অফিসফেরত যে মা কাপড় ভাঁজ করে গুনগুন করতেন, ‘বড়ো আশা ক’রে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও, ফিরায়ো না জননী’, সেই মায়ের কণ্ঠ সাময়িক সময়ের জন্য শুনতে না পেয়ে আমার জগৎ হয়ে গেল অন্ধকার। টের পেলাম, যাঁর বকুনিতে বিরক্ত হওয়াই ছিল কিশোরীকালের রোজনামচা, তাঁর কণ্ঠে বকা শোনার তৃষ্ণা কতটা হাহাকারের হতে পারে।

কন্যা বলেই এত ঝক্কি কিনা; তাই কখনোই মায়ের কন্যাসন্তান হতে চাইনি, চেয়েছি কেবলই সন্তান হতে।

ব্যালকনিতে নতুন ফুল ফুটলে মা ছবি তুলে পাঠান, কোনো সুন্দর জিনিস দেখলেই তা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হন। মাকে মিষ্টি এক কিশোরী মনে হয়, যাঁকে ভাবলেই মনে ফড়িং উড়ে বেড়ায়। অথচ দুশ্চিন্তার অভ্যাসের পরিবর্তন হলো না বলেই কিশোরীর অবয়ব থেকে বেরিয়ে পুরোদস্তুর মায়ের আসনেই ফেরেন তিনি। সারাক্ষণ দূর দেশের দুরন্ত কন্যার দুশ্চিন্তায় থাকেন। কন্যা বলেই এত ঝক্কি কিনা; তাই কখনোই মায়ের কন্যাসন্তান হতে চাইনি, চেয়েছি কেবলই সন্তান হতে।

আমার বুনো ফুলের মতো মা সুস্থতা ও শান্তিতে পৃথিবীর বুকে হাজার বছর এভাবেই সুঘ্রাণ ছড়াক। যে ঘ্রাণ এই ভিনদেশে সন্ধ্যা নামলেই অনুভব করতে পারি!

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী