‘স্বপ্নজাল’ যেন বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের স্বপ্নের বীজ

স্বপ্নজাল ছবিতে ইয়াশ রোহান ও পরীমনিসংগৃহীত
শুভ্রা চরিত্রে পরীমনি এই চলচ্চিত্রে নায়িকা নন, এতটুকু অভিনয় বা অতি অভিনয় করেননি। নায়িকাসুলভ সমস্ত ইমেজ ভেঙে প্রকৃত অর্থেই যেন হয়ে উঠেছেন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এক শুভ্রা।

গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল। গভীর মায়াচ্ছন্ন ‘স্বপ্নজাল’-এ তিনি আবার অতল ঘোরের মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন। কবিরা শিশিরের শব্দ শুনতে পান। কবিতায় শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা নেমে আসতে দেখলে কবির সেই মোহাচ্ছন্ন প্রগাঢ় অনুভূতি পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে যায়। কিন্তু একজন চিত্রশিল্পী তাঁর ক্যানভাসে কীভাবে কুয়াশাকে ধরবেন? শিশির পতনের শব্দ দর্শকের কর্ণকুহরে প্রবেশ করাবেন? সবাই পারেন না। কেউ কেউ চিত্রের ভাষাতেও এই কঠিন কাজগুলোকে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। দর্শককে শুধু ছবির বুকে কান পেতে অনুভূতির গভীরে গিয়ে শব্দটুকু শুনে নিতে হয়। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের চলচ্চিত্রের ভাষাও ঠিক এমনই কঠিনকে সহজ করে তুলে আনা এবং দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখার মতো বাস্তবতার মায়াজাল।

বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজের সমারোহ পৃথিবীর বাগান, প্রকৃতির ভাষা, গাছের ভাষা, ফুলের ভাষা, নদীর ভাষা, রূপালি ইলিশের ভাষা, জল তরঙ্গ, পাখির ডাক, মাঝিমাল্লাদের ভাষা, গাছের বুকে যোগ চিহ্ন দিয়ে লিখে রাখা প্রেমিক-প্রেমিকার নাম, নদীর বুকে নৌকায় ভেসে প্রাণপ্রিয়ার স্বর্গীয় জন্মদিন উদ্‌যাপন, শহরের চলন্ত ট্রাম, মোটর বাইকের শব্দ, বৃষ্টির তালে তালে মন ময়ূরীর পেখম তুলে নাচ, মানুষের বমির, এমনকি মানুষের প্রাকৃতিক ডাকের শব্দ পর্যন্ত তুলে আনতে পারেন এই পরিচালক। এখন আপনি যদি বলেন, ভোরে রেওয়াজে বসা এক বনেদি পরিবারের কন্যার গানটাই শুধু শিল্প; মদ্যপান করতে করতে লিভার কিডনি পচিয়ে ফেলা একজন ক্যানসার রোগী বা বড় ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে বসা একজন অসুস্থ মানুষের মলত্যাগ করার শব্দটা শিল্পের ভাষা নয়, সেটা আপনার বোঝার সমস্যা। অতি সূক্ষ্ণ জীবন নিরীক্ষণ ছাড়া এমন চলমান জীবন ছবি নির্মাণ করা সম্ভব নয়। দক্ষ পরিচালক সেলিমের সঙ্গে কামরুল হাসান খসরুর অসামান্য ক্যামেরার ভাষা, রশীদ শরীফ শোয়েবের সুর সংযোজন এবং ইকবাল আহাসানুল কবীরের সম্পাদনায় জীবন এবং সমাজের সব সুন্দর এবং কুৎসিত পোড়া দগ্ধ ক্ষতগুলো উঠে আসা। সুন্দর একটি সৃষ্টির ডানা মেলে উড়াল দেওয়া।

দেখে বোঝাই যায়, সেলিম আসলে দীর্ঘদিন ধরে খুঁটিনাটি গবেষণা করে গল্প এবং চিত্রনাট্য বোনার সময় চোখের সামনে দৃশ্যগুলোকে দেখতে পান। যোগ্য উপযুক্ত প্রযোজকের সন্ধান পেলে এরপর চোখে দেখা মনের ভাষাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করেন। শিল্পীর স্বাধীনতায় কেউ যদি হস্তক্ষেপ করে, তাতেও একজন দক্ষ শিল্পী নিজেকে মেলে ধরতে পারেন না। উদার প্রযোজক ছাড়া সেলিমের মতো পরিচালকদের মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়। যোগ্য পরিচালকের এক একটি চলচ্চিত্র গোটা একটা দেশকে পরিবেশন করে, এসব বড় বড় কথা অনেকেই বলি। কিন্তু শিল্পী মাত্রেই জানেন বাস্তবে তিনি কতটা নিঃসঙ্গ, লক্ষ লক্ষ মানুষের একটা জাতির জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়েও শুরুতে তিনি পাশে যোগ্য খুব কম মানুষকে পান; অথবা তেমন কাউকে হাতড়ে হাতড়েও পান না। মননশীল পরিচালকদের এগুলো চিরকালীন সমস্যা।

‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রের সোনাইয়ের মতো এই চলচ্চিত্রেও দেখলাম হিরণ সাহাকে অজানা চরে রেখে আসা হয়েছে। কারণ অবশ্য ভিন্ন। হিরণ সাহা মাছের ব্যবসা, বড় মিল কারখানা অনেককিছু নিয়ে বনেদি পরিবারের একজন অবস্থাপন্ন হিন্দু ব্যবসায়ী। আয়নাল গাজী সবকিছু আত্মসাৎ করার জন্য তাকে দ্বীপান্তর করেছে এবং বসতভিটেসহ সব সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়ে সেখানে হত্যা করে রেখে এসেছে। বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে হিরণের সুখের সংসার ছিল। আয়নাল গাজী মিথ্যা প্রচার করে দিয়েছে, সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে আয়নালের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হিরণ নতুন একটা বিয়ে করে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইন্ডিয়া থেকে হিরণের বয়ানে পরিবারের কাছে একটা চিঠিও আসে। যেখানে লেখা হয়, সবাই যেন কলকাতায় হিরণের শ্যালিকার বাড়িতে চলে যায়। হিরণ সেখানে আছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপরে কতরকম ভাবে নির্যাতন হয়, তার একটা নির্মম, নির্জলা সত্যের দৃষ্টান্ত পরিচালক এখানে শিল্পীত মাধ্যমে তুলে এনেছেন।

হিরণের মেয়ে শুভ্রা। সে ভালোবাসে পাড়ার মুসলিম পরিবারের বন্ধু অপুকে। হিন্দু-মুসলিম এই দুই তরুণ-তরুণীর ভালোবাসার গল্প অন্য আরেকটি চিরকালীন মহাকাব্যিক আখ্যানের মতো বিস্তার লাভ করে। দুজন দুজনকে পাগলের মতো ভালোবাসে, চোখে চোখে হারায়। পরিস্থিতির চাপে পড়ে শুভ্রাকে তবু অপুর হাত ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে যেতে হয়। দুজনে দুজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় কেউ কাউকে ভুলে যাবে না। শুভ্রাদের বসতবাড়িসহ সব সম্পত্তি আয়নাল এবং তার লোকেরা ভোগ করতে থাকে। অপু সব ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে যায়। আর শুভ্রা কলকাতায় মাসির বাড়িতে গিয়ে দেখে সেখানে বাবা যায়নি।

সাধারণত আমরা দেখি সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে দেশ ছেড়ে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না। কিন্তু মানবতাবাদী বোদ্ধা পরিচালক আমাদের দেখালেন, দেশটা আমার যতটা তোমাদেরও ততটা। তোমরা দেশ ছেড়ে যাবে কেন? অন্যায় হয়েছে, অন্যায়কারীর উপযুক্ত শাস্তি হবে। এখানে মুসলমান ছেলে অপু হিরণ সাহা হত্যার বিচারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে। কলকাতায় গিয়ে শুভ্রাকে নিয়ে আসে। দুজনে মিলে প্রত্যক্ষ রাজসাক্ষী যোগাড় করে উকিলের সাহায্য নিয়ে আয়নালকে ধরিয়ে দেয়। হারানো সম্পত্তি উদ্ধার করে। কাঁটাতারের ব্যবধান ঘুচিয়ে শুভ্রার পরিবার, দেশের মানুষ আবার দেশে ফিরে আসে।

কিন্তু অপু আর শুভ্রার ধর্মের বিভাজন ঘোচে না। পরিণতি অত্যন্ত হৃদয় বিদারক হয়ে ওঠে। ভালোবাসার মানুষের পাশে এতদূর লড়াই করে এসেও অপুকে হেরে যেতে হয়। শুভ্রাকে হৃদয়বিচ্ছিন্ন হতে হয়।

শুভ্রা চরিত্রে পরীমনি এই চলচ্চিত্রে নায়িকা নন, এতটুকু অভিনয় বা অতি অভিনয় করেননি। নায়িকাসুলভ সমস্ত ইমেজ ভেঙে প্রকৃত অর্থেই যেন হয়ে উঠেছেন সাধারণের মধ্যে অসাধারণ এক শুভ্রা। পরীমনি শুভ্রার পাশে যোগ্য অপু হয়ে উঠেছেন একেবারে নতুন মুখ ইয়াশ রোহান। একজন শক্তিমান পরিচালকের মননশীল চলচ্চিত্রে স্টার, সুপারস্টারদের নাম ভাঙিয়ে দর্শক টানতে হয় না। স্রোতের মতো মানুষ নদীর ধারার কাছে এসে আপনাতেই মাথা নত করে দেয়। প্রকৃত অভিনেতা শিল্পীদের এই ধরনের পরিচালকরা আবিষ্কার করেন।

‘মনপুরা’ চলচ্চিত্রে পরীর বাবা ফজলুর রহমান বাবু এই চলচ্চিত্রের কুখ্যাত ভিলেন আয়নাল গাজী। তিনি একজন জাত অভিনেতা, এই চলচ্চিত্রের শিল্পমানকে অনেক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছেন। আয়নালের মদ্যপানের পর বমি, খেতে খেতে বমি পায়খানা করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার মধ্যে, নির্যাতিত মানুষের অভিশাপের প্রতিফলন হিসেবেও দেখা যেতে পারে। যারা শোষকের সঙ্গে পেরে ওঠে না, মনে মনে শুধু অভিশাপ দেয়; একদিন ঈশ্বর এই অমানুষদের বিচার করবে। শোষিত দূর্বল মানুষের কাছে ঈশ্বরই যে একমাত্র অবলম্বন।

আবার নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের বিষয়গুলো এভাবে যত বেশি শিল্পমাধ্যমে উঠে আসবে, মানুষ সংবেদনশীল হয়ে উঠবে। সংখ্যালঘুরাও দেশ ও দশের প্রতি বিশ্বাস না হারিয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যেতে পারবে।

অপুর বাবা শহীদুল আলম সাচ্চুর বাংলা উচ্চারণ অত্যন্ত মধুর, হৃদয়গ্রাহী। ভিলেনের চরিত্রে তাঁকে অনেকে ব্যবহার করেন। সমাজের মননশীল ব্যক্তি বুদ্ধিজীবীর চরিত্রেও তিনি দাগ কাটতে পারবেন। পরিচালকরা ভেবে দেখতে পারেন। আর অভিনেতা সাচ্চু চলচ্চিত্রের পাশে আবৃত্তি, বাচীকশিল্পের দিকেও যদি একটু সময় দেন, এই কণ্ঠ অনেকের হৃদয় স্পর্শ করবে বলে মনে করি। বাংলাদেশের শিল্পীদের পাশে কলকাতার অনেকেও এই চলচ্চিত্রে সুন্দর অভিনয় করেছেন। এখানেও পরিচালক জাত অভিনেতাদের খুঁজে নিয়েছেন।

‘স্বপ্নজাল’ বাংলা ভাষার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক আশার, স্বপ্নের বীজ রোপণ করে গেল।

হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত