সবকিছু যেন অসমাপ্ত থেকে যায়

অলংকরণ: আরাফাত করিম

খুব সাধারণ জীবন ছিল বঙ্গবন্ধুর। যে জীবনে ছিল না ঐশ্বর্যের ছোঁয়া। সংগ্রামই ছিল জীবনের ঐশ্বর্য। রাজনীতির এক সাধারণ কর্মীর মতো করেই শুরু করেছিলেন জীবন। আর সেই তিনিই হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মহান পুরুষ। তাঁর নেতৃত্বে সৃষ্টি হয় একটি রাষ্ট্র! একটি পতাকা। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনার শক্তি কোথায়?’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ ‘আপনার দুর্বলতা কোথায়?’ ‘আমি আমার জনগণকে অনেক বেশি ভালোবাসি।’

যে মানুষ এমন করে বলতে পারেন, যে ব্যক্তিপুরুষের এমন জীবনদর্শন, তাঁর আবির্ভাব ঐতিহাসিক। এমন মানুষ যুগে যুগে আসেন না। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নিউজউইক সাময়িকী তাঁকে উপাধি দেয় ‘রাজনীতির কবি’। বিবিসি জরিপে তিনি হন ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’।

আর তাই যত দিন এই পৃথিবীতে থাকবে উত্তাল সাগর, আকাশের তারা, মেঘেদের ভেসে বেড়ানো, বৃষ্টির জলতরঙ্গ; তত দিন তিনি থাকবেন কবির কবিতায়, লেখকের ভাবনা ও ইতিহাসের পাতায়। ‘আমি নিহত হওয়ার জন্য তৈরি ছিলাম।’ মৃত্যু নিয়ে যে বঙ্গবন্ধুর এমন ভাবনা, সেই মৃত্যু তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি হয়ে ওঠেন অমরত্বের বিশালতার প্রতীক।

আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য “বলাকা” নয়, “সোনার তরী” নয়, বাঙালির শ্রেষ্ঠ কাব্য “আর দাবায়ে রাখতে পারবা না”।’

স্কুলজীবন থেকেই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ ছিল সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। পরবর্তী সময়ে তিনি নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামে যুক্ত হন। সেটা ছিল ১৯৫২ সাল। তখন চীনের পিকিং শহরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলন হয়। তিনি এ সম্মেলনে যোগ দেন। সেখানে নানা দেশের শান্তিকামী নেতাদের সঙ্গে তাঁর কথা হয়। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘রাশিয়া হোক, আমেরিকা হোক, ব্রিটেন হোক, চীন হোক, যেই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে, তাদের সঙ্গে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই।’

বঙ্গবন্ধু জীবনে কখনো ঘৃণা ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। একাত্তরের ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি বলেছিলেন, ‘দেখবেন, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ তাঁর নেতৃত্বের গুণ ছিল অসাধারণ! মুহূর্তে তিনি লাখো মানুষকে সংঘবদ্ধ করতে পারতেন।

বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের রাজনীতি ছিল গণতান্ত্রিক, শান্তিপূর্ণ এবং অহিংস। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণ-বঞ্চনার সময় তাঁর নেতৃত্বে বাংলার মুক্তির আন্দোলন ক্রমাগত বেগবান হয়েছে। কিন্তু সব সময়ই তিনি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করেছেন। একইভাবে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণও ছিল শান্তিপূর্ণ। একাত্তরে স্বাধীনতাসংগ্রামে মানবজাতির সামনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন শান্তি, মুক্তি ও মানবতার প্রতীক। মহাত্মা গান্ধী ও মার্টিন লুথার কিংয়ের সঙ্গে তাঁর তুলনা হতো।

তাঁর প্রতিটি কাজ প্রমাণ করে, তিনি কতটা মানবিক ছিলেন। তিনি অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন, দেশ একদিন মুক্ত হবে। দেশের মানুষ সমৃদ্ধ হবে। সবার একটি হাসি–আনন্দময় জীবন থাকবে। তাঁর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা ছিল—সবার সঙ্গে মৈত্রী, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের অধিবেশন ছিল। সেখানে তিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে বিশ্বশান্তির ওপর গুরুত্ব দেন। বক্তৃতা শেষ করেন মানুষের অজেয় শক্তির ওপর বিশ্বাস রেখে।

বঙ্গবন্ধু এ দেশের দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি দেখতে চেয়েছেন। সব সময় চিন্তা করতেন, দারিদ্র্য যেন কারও জীবনের আনন্দগুলো কেড়ে না নেয়। প্রতিনিয়ত এসব চিন্তায় তাঁর মন খারাপ হতো। কারণ, মানুষের জন্যই ছিল তাঁর সংগ্রাম। তিনি কখনো নিজের সুখের কথা ভাবতেন না।

কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে থেকেও এ দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন। অনশন করেছেন জেলখানায়। কষ্ট করেই কষ্টগুলো জয় করেছেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, তিনি যদি স্বাধীনতা দেখে যেতে না-ও পারেন, বাংলার মানুষ অবশ্যই একদিন স্বাধীন হবে। মানুষের কোনো ত্যাগই বৃথা যায় না। বঙ্গবন্ধুরও যায়নি। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন সফল করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলার মানুষ পেয়েছে একটি লাল-সবুজের পতাকা, একটি মানচিত্র।

বাড়ির পাশেই নদী। নদীর মতো বয়ে গেছে তাঁর জীবন। একবার এই নদী দিয়ে টুঙ্গিপাড়া যাচ্ছিলেন। পথে ডাকাতেরা নৌকা আক্রমণ করল। মাঝিকে তারা বলল, ‘নৌকায় কে।’ মাঝি বলল, ‘শেখ সাহেব।’ ডাকাত মাঝিকে আঘাত করে বলল, ‘আগে বলবি না, নৌকায় শেখ সাহেব।’ এ থেকে বোঝা যায়, এলাকার মানুষ তাঁকে কত শ্রদ্ধা করত।