ফিতাওয়ালা জুতা

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

অফিসে কাজের চাপ কম থাকায় পাঁচটার আগেই বেরিয়ে পড়লাম। মাসের শেষ। বাসায় কিছু কাজ জমে আছে, সেগুলো করতে পারলে ভালো হয়।

বাসায় এসে কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল স্ত্রী জুনিয়া। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে ছেলে বলল, ‘বাবা, আজকে আমাকে জুতা কিনে দিতেই হবে। তোমার আর কোনো কথাই আমি শুনব না।’

সপ্তাহ ধরে রেইআন বায়না ধরেছে তাকে মার্কেটে নিয়ে জুতা কিনে দিতে হবে। তার স্কুলের জুতা নষ্ট হয়ে গেছে। কয়েক দিন পর স্কুল খুলবে, গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। রেইআন এখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

হাত থেকে অফিসের ব্যাগটা নিয়ে জুনিয়া বলল, ‘বড় ভাইজান এসেছেন অনেকক্ষণ হলো। দুপুরের খাবার খেয়ে কখন থেকে তোমার জন্য বসে আছেন! তুমি ফ্রেশ হয়ে দেখা করো।’

ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই বড় ভাইজানকে দেখতে পেলাম। সোফায় বসে আছেন। সালাম দিলাম। ক্লান্ত লাগলেও ফ্রেশ না হয়ে কিছুক্ষণ বসে কথা বললাম। দুই সপ্তাহ বাদে বড় ভাইয়ের বড় মেয়ে মেরুলের বিয়ে, এ বিষয়ে কথা হলো। বড় ভাই চলে গেলেন। ফ্রেশ হয়ে টেবিলে খেতে বসলাম। খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই দেখি রেইআন পরিপাটি পোশাক পরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

খাবার টেবিল থেকে উঠে হাত ধুয়ে রুমে গেলাম প্রস্তুত হতে। বুঝলাম আজ আর বাসার কাজ কিংবা বিশ্রাম কোনোটাই হবে না। ছেলেকে নিয়ে বের হতেই হবে। পোশাক পরছি আর ভাবছি, এমন আবদার আমিও আব্বার সঙ্গে একবার করেছিলাম।

তখন সবে প্রাইমারি শেষ করে হাইস্কুলে উঠেছি। স্কুলে সবাই নতুন পোশাক আর জুতা পরে আসত। আমার পোশাক ছিল পুরোনো, যা ছিল বড় ভাইয়ের। আর জুতার বদলে পরতাম স্যান্ডেল। মুখে কেউ কিছু না বললেও অনেকেই আড়চোখে পায়ের দিকে তাকাত। একদিন বন্ধুরা তো বলেই বসল, ‘তুই একটা নতুন জামা জুতো কিনে দিতে বলতে পারিস না বাবাকে।’

সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখি আব্বা খেতে বসেছেন। আম্মা পাশে বসে আব্বাকে খাবার দিচ্ছেন। আমি কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে বললাম, ‘আব্বা, আমাকে আজকে ফিতাওয়ালা জুতা কিনে দিতেই হবে, না হলে ভাত খাব না।’ হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে কান্না করতে লাগলাম।

আব্বার ভ্যান চালিয়ে সামান্য যে টাকা পেতেন, তা–ই দিয়ে কোনোমতে চলত আমাদের। অভাব কাটত না। সেখানে এই জুতা কেনার নতুন আবদার মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁয়ের মতো ছিল। তখন সেসব বোঝার বয়স কিংবা বুদ্ধি কোনোটাই আমার ছিল না।

সেদিন সন্ধ্যায় আব্বা আমাকে রেলস্টেশনে নিয়ে যান। প্ল্যার্টফর্মের বাইরে খোলা আকাশের নিচে ছোট কয়েকটি দোকান ছিল। মাটিতে ছালা পেতে বসে ছিল কয়েকজন দোকানদার। বিভিন্ন জিনিসের সঙ্গে কিছু জুতাও ছিল সেখানে। কয়েক জোড়া জুতা থেকে আমার মাপমতো এক জোড়া জুতা আব্বা বের করলেন। বললেন, ‘দেখ তো মেহমেদ, পায়ে লাগে কি না?’

জুতা পায়ে দিতে দিতে দেখছিলাম। ময়লা ছিল কিছুটা, হয়তো কেউ ব্যবহার করেছে। তবে নতুন না, এটা বুঝতে পারছিলাম। তাতে মাথাব্যথা ছিল না। আমার ফিতাওয়ালা জুতা হলেই হলো, হোক তা পুরোনো কিংবা নতুন। অনেক দামাদামি করে বাবা ২০ টাকা দিয়ে জুতা জোড়া কিনেছিলেন। নতুন ফিতাওয়ালা জুতা পেয়ে অনেক খুশি হয়েছিলাম।

পেছন থেকে হঠাৎ ‘আব্বা’ ডাক শুনতে পেলাম। ডাকছে রেইআন । ‘বাবা, চলো না, দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ জুনিয়া ছেলের কাণ্ড দেখে হাসছে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি বের হও।’

বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা নিলাম। বড় বাজারের শতরুপা মোড়ে অনেকগুলো বড় জুতার দোকান আছে। রেইআন বলছে, ‘আমার জুতা কিন্তু লাল কালার হবে, না না নীল হবে, না হলুদ হবে।’

আব্বার কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন আব্বার চেহারায় হাসির পেছনে যে ক্লান্তি আর কষ্টের ছাপ ছিল, তা বুঝতে পারিনি। আজ বুঝতে পারি।

হাজীপুর, নরসিংদী