আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য জুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি, কে কী খেতে চায় না, অন্যের বাচ্চারা সবকিছু খায় আমরা কেন খাই না, কেন মাছের কাঁটা বেছে খেতে পারি না, কেন দুধ খাই না, কেন বেলা গড়িয়ে খাবার খাই, কেন এক কথায় সব কাজ করি না, কেন এত ভুলোমনা, এত অগোছালো, বাবা কেন এটা করেন না, ওটা করেন না। এত্তসব কেন, কেন ছাড়াও মা’র কথা বলার আরও অনেক কারণ ছিল। জীবন বলতে তাঁর শুধু এতটুকুই ছিল—স্বামী, সন্তান আর সংসার। এর বাইরে গিয়ে কিছু ভাবতেই পারতেন না।
মা-বাবার অনেক আদরের মেয়ে ছিলেন আমার মা। ওনার মুখে শুনেছি, নানা নাকি মায়ের সব আবদার পূরণ করতেন। খুব যত্ন করে বড় করেছিলেন। নানা নিজ হাতে মায়ের চুল আঁচড়ে দিতেন; যাতে মা চুল আঁচড়ে ছিঁড়ে একাকার করে না ফেলেন। নানাজানের এত আদুরে মেয়ে একদিন আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের বউ হয়ে আসেন। যে মেয়ে নিজ হাতে তুলে খাবার খেত না, সে মেয়ে বড় বাড়ির বড় ছেলের বউ। দায়িত্ব অনেক!
মা আনাড়ি হাতে সংসার সামলানো শুরু করেন। সংসার করতে করতে কখন যে তাঁর মা-বাবার আদুরে মেয়ে থেকে একটা একান্নবর্তী পরিবারের ঠিকে-ঝি হয়ে গিয়েছিলেন, টেরও পাননি। নানাজান হুটহাট তাঁর আদুরে মেয়েকে মানে আমার মাকে নাইয়র নিতে চলে আসতেন। কিন্তু মা ঘরকন্নায় এতটা ব্যস্ত থাকতেন, নানাজানের হাতে একগ্লাস পানি তুলে দেওয়া তো দূরের কথা—এক পলক দেখা করারও সুযোগ পেতেন না। ওদিকে নানাজানও দাওয়ায় বসে দাদাজানের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মেরে মেয়েকে খুঁজতেন।
বেলা গড়িয়ে এলে মা সাংসারিক কাজবাজ গুছিয়ে নানাজানের সামনে এসে দাঁড়ালেও মানুষজনের ভয়ে দুটো সুখ-দুঃখের কথা বলার সাহস পেতেন না। মা শ্বশুরবাড়িতে এতটাই অসহায় ছিলেন, প্রাণপ্রিয় বাপজানকে নিজের মতো করে রেঁধে–বেড়েও খাওয়াতে পারতেন না। নানাজানের বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসত, কিন্তু মা আমাদের বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে বাবার বাড়ি যাওয়ার অনুমতি পেতেন না। নানাজান কেঁদে বুক ভাসিয়ে মেয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতেন। মা-ও আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন।
মা যখন অসুস্থ হয়ে চুপ করে যেতেন, আমার তখন ভীষণ খারাপ লাগত। সারা বাড়িজুড়ে নেমে আসত নিঝুম রাত। মনে হতো, বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। আমি তখন মায়ের পাশে বসে তাঁকে কথা বলানোর চেষ্টা করতাম। কে আমাকে বকা দিয়েছে, আমার অন্য ভাইয়েরা কে ঘর নোংরা করেছে, মাকে নিয়ে কে কী কটূক্তি করেছে, বাবা বাইরে কী কী করেছে—এসব বিষয় মাকে বলতাম। আমার উদ্দেশ্য একটাই—মাকে কথা বলাতে হবে। আমার বিশ্বাস ছিল, কথা বললেই মা সুস্থ হয়ে যাবেন। তারপর মা কথা বলতে শুরু করতেন, সবাইকে বকা দিতেন। আমি আনন্দ নিয়ে সেসব দেখতাম আর ভাবতাম—মা সুস্থ হয়ে গেছেন।
কিন্তু শেষের দিকে আমার এই বিদ্যা কাজে লাগেনি। শত চেষ্টা করেও মাকে কথা বলাতে পারিনি। আমার মা আর কথা বলেননি। তখন থেকেই আমাদের স্নিগ্ধ সকাল, নিদাঘ দুপুর, রোদেলা বিকেল আর কাজল সন্ধ্যার মুহূর্তগুলো রূপান্তরিত হলো নিকষ কালো নিঝুম রাতে।
বনশ্রী, ঢাকা